ভারতের ফারাক্কা বাঁধের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। নদনদীর অববাহিকা ছাড়াও কৃষিপ্রধান অঞ্চলে মরুকরণ দ্রুত গতিতে বাড়ছে। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁসহ ১২টি জেলায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঘন ঘন দাবদাহের কারণে প্রকৃতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রাণিকুল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফারাক্কার প্রভাবে বছরের আট মাস বাংলাদেশের নদীগুলো পানিশূন্য থাকে। ফলে মাটির আর্দ্রতা কমে গেছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভয়ানকভাবে নেমে গেছে। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫০ ফুট গভীর নলকূপেও এখন আর পানি মিলছে না। ফলে কৃষি, মৎস্য ও গবাদিপশু পালন চরম সংকটে পড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী:
পদ্মা অববাহিকায় ৩৩ হাজার ৬৮০ হেক্টর বিল, ৮৪ হাজার ৪৯৮টি পুকুর এবং ৬ লাখ ১০ হাজার ৪৬৭ হেক্টর প্লাবনভূমি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে।
পদ্মার উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ভাটিতে ফরিদপুর পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার এলাকা পানির সংকটে ভুগছে।
পানির অভাবে পদ্মার তীরবর্তী চরাঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভূগর্ভস্থ পানি স্তর ৭১% এলাকায় মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিতে পৌঁছেছে।
ফারাক্কার কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশগত ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় অঞ্চলজুড়ে বৃষ্টিপাত কমে গেছে, তাপমাত্রা বেড়েছে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায় এবং প্রতিদিনের তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী থাকে প্রায় ২০ দিন।
রাজশাহীর চরাঞ্চলগুলোর মানুষেরা এখন নদীর ধারে থেকেও পানির অভাবে ভুগছেন। চরভুবনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম জানান, আগে পদ্মার পানি গবাদিপশুর বড় উৎস ছিল, এখন চরাঞ্চলজুড়ে শুধু ধু-ধু বালুচর দেখা যায়। টিউবওয়েলে পানি উঠে না, মানুষ এখন ভূগর্ভের পানি মোটর দিয়ে তুলে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মত: ফারাক্কার একতরফা পানি প্রত্যাহারে পদ্মা ও এর শাখানদীগুলোতে নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। জলাধারগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় গাছপালা পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না, যা উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ভূগর্ভস্থ পানি স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় মরু প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, শুধু রাজশাহী অঞ্চলে গত দুই দশকে ১০ হাজারের বেশি হস্তচালিত নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির ঘাটতি এভাবে চলতে থাকলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন, যাতে পানির সংকট মোকাবিলা এবং পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করা যায়।
মন্তব্য করুন