খাদ্য শুধু দেহের জন্য নয়, আত্মার ওপরও প্রভাব ফেলে—এ বিশ্বাস ইসলামি জীবনদর্শনের অন্যতম ভিত্তি। একজন মুসলমানের জন্য হালাল রুজি যেমন ফরজ, তেমনি হালাল খাদ্যও ঈমানের দাবি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোন খাবারগুলো ইসলাম অনুযায়ী হারাম এবং কেন? এ প্রতিবেদনে আমরা কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে হারাম খাবারের কারণ ও যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করব।
ইসলামে খাদ্যকে সাধারণভাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়: হালাল (বৈধ), হারাম (নিষিদ্ধ) ও মাশবুহ (সন্দেহযুক্ত)।
ইসলামে সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হলো আল্লাহ ও রাসুল (স.)-এর নির্দেশ। কিছু খাবার কোরআনে সরাসরি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে: মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং যে জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়েছে…।’ (সুরা বাকারা: ১৭৩)
ইসলাম এমন সব জিনিস নিষিদ্ধ করেছে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। মদ, গাঁজা, ও অন্যান্য মাদক শরীর ও সমাজে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। তাই তা নিষিদ্ধ। বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পবিত্র বস্তু হালাল করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ, জমিনে যা আছে, তা থেকে হালাল পবিত্র বস্তু আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা: ১৬৮)
হারাম খাদ্য শুধু দেহ নয়, আত্মাকেও অপবিত্র করে। এমনকি দোয়া কবুলে বাধা আসে। রাসুল (স.) বলেন. ‘এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত হয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করছে, অথচ তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারামে লালিত—তাহলে তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে?’ (সহিহ মুসলিম: ২৩৯৩)
যে খাবার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সেই মাংস খেয়ো না, যা আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়নি।’ (সুরা আনআম: ১২১)
যে খাদ্য হালাল না হারাম—সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে, তাও এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। আর এ উভয়ের মধ্যে এমন অনেক সন্দেহভাজন বিষয় বা বস্ত্ত আছে, যে ব্যাপারে অনেক মানুষই এগুলো হালাল, কি হারাম- এ বিষয়ে অবগত নয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় হতে বিরত থাকবে, তার দ্বীন ও মান-মর্যাদা পুত-পবিত্র থাকবে। (মেশকাত: ২৭৬২)
মৃত পশু (জবাই ছাড়া): অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর। (সুরা বাকারা: ১৭৩)
রক্ত: স্বাস্থ্যহানি ও অপবিত্রতার কারণ। (সুরা আনআম: ১৪৫)
শুকরের মাংস: নাপাক, শারীরিক ক্ষতির কারণ। (সুরা মায়েদা: ৩)
মদ ও মাদক: নেশা ও সমাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ। (সুরা মায়েদা: ৯০)
আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবাইকৃত: শিরকের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা আনআম: ১২১)
চুরি/ঘুষের টাকায় কেনা খাবার: হারাম উপার্জন। (সহিহ মুসলিম: ২৩৯৩)
ইসলামে হালাল খাবার হলো সেই সব খাদ্য, যা কোরআন ও হাদিসে নিষিদ্ধ করা হয়নি, যা পবিত্র ও উপকারী, যা সঠিকভাবে আল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে এবং যা মানুষের শরীর, মন ও সমাজের ক্ষতি করে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র, তা খাও।’ (সুরা বাকারা: ১৬৮) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করে, তাদের জন্য কী হালাল করা হয়েছে। বলুন, তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে পবিত্র বস্তু।’ (সুরা মায়েদা: ৪)
অর্থাৎ, হালাল খাবার শুধু শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধই নয়, তা নিরাপদ ও উপকারীও। এই খাদ্য ঈমানদার ব্যক্তিকে শারীরিক ও আত্মিকভাবে সুস্থ রাখে।
ইসলাম শুধু ইবাদত নয়, বরং জীবনের প্রতিটি দিক—বিশেষত খাবার নিয়েও পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। হারাম খাবার থেকে বিরত থাকা মানে শুধুই স্বাস্থ্য রক্ষা নয়, বরং আত্মা, ঈমান ও দোয়ার গ্রহণযোগ্যতা রক্ষা করা। তাই একজন মুসলমানের উচিত, হালাল খাবার গ্রহণ এবং হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাদ্য থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করা যায়।
মন্তব্য করুন