গ্রিনল্যান্ড, বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ, একটি ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক মিশ্রণ। ডেনমার্কের অধীনস্থ হলেও দ্বীপটি একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এর খনিজ সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ড কেনার আগ্রহ প্রকাশ করার পর থেকে এটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
গ্রিনল্যান্ডের আদি জনগোষ্ঠী ইনুইটরা প্রায় ৪৫০০ বছর আগে এখানে বসতি স্থাপন করেন। তাদের সংস্কৃতি, জীবিকা এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাসের ভিত্তি তৈরি করেছে।
১০ম শতাব্দীতে নরওয়েজীয় অভিযাত্রী এরিক দ্য রেড দ্বীপে ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করেন। ১৪শ শতকে, ডেনমার্ক-নরওয়ে রাজ্যের অধীনে এটি আসে। ১৮১৪ সালে ডেনমার্ক ও নরওয়ে আলাদা হলে গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে চলে যায়।
ডেনমার্ক নাৎসি জার্মানির দখলে যাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ সময় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থুলে এয়ার বেস প্রতিষ্ঠা করে, যা আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৫৩ সালে গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৯ সালে গ্রিনল্যান্ড স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। বর্তমানে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো গ্রিনল্যান্ডের নিজস্ব সংসদ পরিচালনা করে।
গ্রিনল্যান্ডে রয়েছে বিশাল পরিমাণ তেল, গ্যাস, এবং বিরল খনিজের মজুদ। এই খনিজ উপাদানগুলো বৈশ্বিক সবুজ প্রযুক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তি উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে, চীন এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ।
গ্রিনল্যান্ড আর্কটিক মহাসাগরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নতুন সমুদ্রপথ উন্মুক্ত হচ্ছে, যা বাণিজ্য ও সামরিক কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
থুলে এয়ার বেস উত্তর আটলান্টিক এবং আর্কটিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। এটি রাডার এবং মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দেন। তার মতে, গ্রিনল্যান্ডের সম্পদ এবং অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
চীন বিশ্বের বিরল খনিজ উপাদানের সরবরাহের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। ট্রাম্প মনে করতেন, গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হলে চীনের প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব।
গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এবং ডেনমার্ক উভয়েই ট্রাম্পের প্রস্তাব নাকচ করেন। তারা এটিকে উপনিবেশবাদী মনোভাবের একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেন।
গ্রিনল্যান্ডবাসী ক্রমশ সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করছে। তবে দ্বীপটির অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং ডেনমার্কের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক স্বাধীনতার পথে বড় চ্যালেঞ্জ।
গ্রিনল্যান্ড শুধুমাত্র ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নয়; এটি আর্কটিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। এর বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ, সামরিক ঘাঁটি এবং কৌশলগত অবস্থান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এবং অন্যান্য দেশের জন্য এর গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। ভবিষ্যতে গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা এবং স্বাধীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আরও জটিল হতে পারে।
মন্তব্য করুন