বই মানুষের সর্বোত্তম বন্ধু আর বই এর বন্ধু রংপুরের বই দাদু ওমর শরীফ।জীবনের নানা চড়াই উতরাই এবং প্রতিকূলতার পরেও বইয়ের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করেননি তিনি।তাইতো বইপ্রেমীদের কাছে পেয়েছেন ‘বই দাদু’ উপাধি।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ বই দাদু দোকানে আসেন বেলা বারোটার দিকে।দোকানেই এসেই এক কাপ চা দিয়ে শুরু হয় তার দিন।চা খাওয়া শেষ করে যত্ন নেন তার বন্ধুদের।এরপরেই অপেক্ষা করতে থাকেন পাঠকদের।
এমনই এক দুপুরে চায়ের আড্ডায় আলাপ হয় রংপুরের এই দাদুর সাথে।তিনি জানান সাধারণ পুরাতন বই বিক্রেতা ওমর শরীফ থেকে বই দাদু হওয়ার গল্প।
ওমর শরীফ জানান,“২০০০ সাল থেকে নিজের বই পড়ার আগ্রহটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পুরোনো বই সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। রংপুর সিটি করপোরেশন এর অপরদিকে কম দামি বইয়ের মার্কেটে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত এক ব্যক্তি রহুল আমিন বিনা মূল্যে নিজের দোকানের একটি অংশ ছেড়ে দেন।সেখানেই তিনি গড়ে তুলেছেন পুরোনো বইয়ের ভান্ডার।”
ওমর শরীফ লেখাপড়া করেছেন সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত।যখন তিনি সপ্তম শ্রেণীতে পড়েন তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আর পড়ার সুযোগ হয়নি তার।কিন্তু বই এর প্রতি ভালোবাসা ছিলো তখন থেকেই।পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে চাকরিতে যোগদান করলেও বই এর টান তাকে নিয়ে আসে চাকরি থেকে।শুরু করেন বই বিক্রি ও ভাড়া দেয়া।
ওমর শরীফ জানান,“শুরুর দিকে পুরোনো বই ভাড়ার বিষয়টি ছিল দারুণ রমরমা।পুরোনো এসব বইয়ের দাম নির্ধারিত মূল্যতালিকা থেকে অর্ধেক ধরা হতো। এই অর্ধেক টাকা জামানত হিসেবে জমা দিয়ে যে কেউ বই নিয়ে গিয়ে পড়তো।আবার বইটি ফেরত দেওয়ার সময় জামানতের পুরো টাকাই ফেরত দেওয়া হতো পাঠককে।এভাবেই বাড়তে থাকে পাঠকসংখ্যা।”
তিনি রংপুর শহরের মুলাটোল পাঠশালা থেকে শেষ করেন প্রাথমিক শিক্ষা।এরপর জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষাজীবন আর দীর্ঘ হয়নি।
তিনি বলেন,“যখন চাকরি শুরু করি তখন পুরোনো বই সংগ্রহের একটা নেশা জন্মে।এরজন্য শহরের বড় বড় বই এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।এখানে সেখানে যেতাম।এরজন্যই চাকরিটা চলে যায়।পরে ফিরে আসি বই এর জগতে আর শুরু করি পুরোনো বই সংগ্রহ ও বিনিময়।”
ওমর শরীফ বর্তমানে মহানগরীর মুলাটোলে পরিবার নিয়ে আছেন।পরিবারে আছেন স্ত্রী ও দুই ছেলে।দুই ছেলের এক ছেলে চাকরি করেন ব্যাংকে ও অন্যজন বেসরকারি কোম্পানিতে।
বইপ্রেমী ওমর শরীফের ভান্ডারে এখন প্রায় পাঁচ হাজার বই রয়েছে। শুরুতে মাত্র দুই টাকা ভাড়ার বিনিময়ে মানুষদের বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে নেমে পড়েন।তবে সময়ের সাথে বইয়ের ভাড়ায় এসেছে পরিবর্তন।প্রকারভেদে ১০ থেকে ৫০ টাকা করা হয়েছে ভাড়ার মূল্য।বই বিনিময়ের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এক প্রজন্মের পরে আরেক প্রজন্মের হাতে বই দাদু তুলে দিচ্ছেন তার গল্পের বই।
রংপুর মহানগরীর আদর্শ পাড়ার বাসিন্দা রুম্পা বলেন,“আগে তো আমরা ছোট থাকতে মায়ের সাথে আসতাম।আর এখন ছেলেমেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।আমি তখন মায়ের সাথে আসতাম তখন তো দাদু অনেক ইয়াং ছিল,তখন আঙ্কেল ছিলো।এখন তো আমার বাচ্চাদের দাদু হয়ে গিয়েছে।ছেলের জন্য তিন গোয়েন্দার বই নিলাম এবং মেয়ের জন্য একটি ছড়ার বই নিলাম।উনার মাধ্যমে অনেক নতুন পাঠক তৈরি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।উনাকে যতো দেখি মুগ্ধ হই।”
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সেজান আহমেদ শুভ বলেন,“২০১০ সালে পুলিশ লাইনে যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম তখন বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারি বই দাদুর কথা।তারপর থেকে উনার কাছ থেকে গল্প উপন্যাসহ অনেক বই নিয়ে পড়েছি।২০১০-১১ সালের দিকে আমরা ৫ টাকা করে দিয়ে একটা বই নিতাম,পরবর্তীতে সেটা ফেরত দিয়ে আরো বই নিয়ে পড়তাম।উনি একজন চির তরুণ মানুষ।বই পাগল এরকম মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।”
আগের মতো দাদুর দোকানে পাঠকের তেমন ভিড় নেই।তাই বই দাদু অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন,“ আগে দিনে ৫০-৬০ জনের মতো পাঠক মিললেও, এখন তা একদমই কমে এসেছে।বর্তমানে গড়ে ১৫-২০ জন পাঠক বই আদান-প্রদান করেন।এখন মোবাইল,ল্যাপটপ থাকতে কে আর বই নিয়ে পড়ে।বই পড়া তো সবাই ভুলেই গেছে।”
শহীদ জররেজ মার্কেটের বড় দোকানের এক কোণে বইয়ের স্তূপ বই দাদুর।গল্পসমগ্র, উপন্যাস, কবিতা, আত্মজীবনীমূলক বইসহ দেশী বিদেশী লেখকদের ও শিশুদের জন্য অনেক বই আছে তাঁর সংগ্রহে।
মন্তব্য করুন