দুই বছর বয়সী হেনরি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে সামনে রাখা আইপ্যাডের স্ক্রিনে। স্ক্রিনে একটি স্মাইলি ফেস দেখলেই সে আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তেই সেই ছবি কোনো একটি প্রাণীর কার্টুনে রূপান্তরিত হয়ে নাচতে শুরু করে। বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ একটি খেলা মনে হলেও, এটি আসলে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। এই গেমের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা চলছে শিশুর মস্তিষ্কে কোন ধরণের মৌলিক দক্ষতা গড়ে উঠছে।
হেনরির মাথায় রয়েছে সেন্সরযুক্ত একটি ক্যাপ, যা সংযুক্ত একটি বিশ্লেষণাত্মক যন্ত্রের সঙ্গে। যখন সে গেম খেলছে, তখন এই সেন্সর তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করছে। পাশাপাশি সে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা দক্ষ, সেটার চিত্রও তৈরি হচ্ছে।
এই গবেষণার মূল বিষয় হলো ‘ইনহিবিটরি কন্ট্রোল’—অর্থাৎ নিজের আচরণ বা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বুঝতে চাইছেন, শিশুদের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো কখন এবং কীভাবে গড়ে ওঠে। কারণ এগুলোই ভবিষ্যতে তাদের মনোযোগ ধরে রাখা এবং শেখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে জানেন যে এই দক্ষতাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখনো অজানা রয়ে গেছে—শিশুর মস্তিষ্কে এই ক্ষমতা ঠিক কোন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাত্র ছয় মাস বয়স থেকে শুরু করে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে এই ক্ষমতাগুলোর বিকাশ হতে থাকে, যা ভবিষ্যতে তাদের একাডেমিক ও সামাজিক সক্ষমতার ভিত্তি গড়ে তোলে।
এই গবেষণায় অংশ নিচ্ছে শত শত শিশু। তবে এই প্রকল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—বর্তমানে যারা অংশ নিচ্ছে, তাদের অনেকের মা-বাবাও একসময় এই একই গবেষণার অংশ ছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে এই মায়েরা যখন নিজেরা শিশু ছিলেন, তখন থেকেই তাদের স্বাস্থ্য ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। ফলে একসঙ্গে দুই প্রজন্মের তথ্য হাতে থাকায় এই প্রকল্পকে একেবারে অনন্য বলে মনে করছেন গবেষকরা।
প্রধান গবেষক ড. কার্লা হোম্বে জানিয়েছেন, শিশুদের কোন সময়ে কী ধরনের দক্ষতা গড়ে ওঠে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কীভাবে বিকাশ লাভ করে—তা জানাটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। কারণ অনেক শিশু স্কুলে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেগুলোর শিকড় রয়েছে অনেক আগেই। এই সমস্যা অনেক সময় কৈশোর পর্যন্ত রয়ে যায়। তাই কম বয়সেই শিশুদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
গবেষণার অংশ হিসেবে শিশুদের এবং তাদের অভিভাবকদের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ল্যাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে শিশুদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গেম, ধাঁধা এবং কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয় এবং সেই সময় তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে ছয় মাস, তিন বছর এবং পাঁচ বছর বয়সে এমআরআই স্ক্যান করা হয়, যা তাদের ক্রমাগত বিকাশমান মস্তিষ্কের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে।
একটি পরীক্ষায় দেখা যায়, আইপ্যাড স্ক্রিনে বারবার ডান পাশে স্মাইলি ফেস দেখানো হচ্ছে। হেনরি যখন সেই অবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন হঠাৎ করে ছবি চলে আসে অন্য পাশে। সহকারী গবেষক কারমেল ব্রফ জানান, এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো দেখা, হেনরি কি আগের অভ্যাস ছাড়তে পারছে এবং নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে কি না।
অন্যদিকে, একই ধরনের এক পরীক্ষা করছে দুই বছর বয়সী জ্যাকসন। তার জন্য একটি ওয়ার্কিং মেমরি (অল্প সময়ের জন্য তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা) ভিত্তিক খেলা তৈরি করা হয়েছে। একজন সহকারী বিভিন্ন পাত্রে স্টিকার রাখছে এবং জ্যাকসনকে মনে রাখতে বলছে কোন পাত্রে স্টিকার আছে। খেলা শেষে সব স্টিকার তার পুরস্কার।
ওয়ার্কিং মেমরি সম্পর্কে ড. হোম্বে বলেন, “এই ক্ষমতা আমাদের প্রয়োজন হয় কোনো সমস্যা সমাধানের সময়, ধাঁধার উত্তর খোঁজার সময়, কিংবা সাম্প্রতিকভাবে কোথায় কী রেখেছি তা মনে রাখার জন্য। পড়া, অঙ্ক বা যেকোনো নতুন জিনিস শেখার সময় এটা অপরিহার্য।”
এই গবেষণায় শিশুদের ভাষার বিকাশ এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণের গতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যা থেকে জানা যাবে তারা কত দ্রুত নতুন তথ্য আত্মস্থ করতে পারে।
এই প্রকল্পের নাম “দ্য চিলড্রেন অফ দ্য ৯০জ”, যা শুরু হয়েছিল ১৯৯১-৯২ সালে। শুরুতে ১৪,৫০০ শিশুকে নিয়ে এই গবেষণা শুরু হয়েছিল। ওবেসিটি, অটিজম এবং কোভিড-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।
এই প্রকল্পের তথ্য বিশ্বের নানা বিজ্ঞানীর কাছে উন্মুক্ত এবং হাজারো গবেষণাপত্রে এটি উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন, গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যদি ছোটবেলায় খেতে অগোছালো হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার স্বাস্থ্য বা বিকাশে তেমন প্রভাব পড়ে না।
আরও একটি উদাহরণ—গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন তরুণের একজন ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি ৪০ জনে একজনের লিভারে ক্ষত দেখা যায়। এর প্রধান কারণ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অ্যালকোহল সেবন, যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
সম্প্রতি আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুর খাদ্যতালিকায় তৈলাক্ত মাছের ঘাটতি রয়েছে, তারা কম সামাজিক ও কম সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
এই গবেষণা এখন নতুন প্রজন্ম—অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে অংশগ্রহণকারী শিশুদের সন্তানদের নিয়ে এগোচ্ছে। গবেষকরা স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই শিশুদের ফলো করবেন।
এই প্রকল্পের অংশ ছিলেন এমিলি, যিনি এখন হেনরির মা। এমিলি বলেন, “আমার মা আমাকে এখানে সাইন আপ করিয়েছিলেন। আগে এটা পছন্দ করতাম না, কিন্তু এখন এটা দারুণ মনে হয়। কারণ আমি জানি, আমি ও আমার সন্তান দুজনেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহায্য করছি।”
ড. হোম্বে বলেন, শিশুর বিকাশের এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্কুলে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্কিল তৈরি হয়ে যায়। তাই এই সময় সঠিক সাপোর্টই শিশুদের ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে দিতে পারে।
এদিকে হেনরি ও জ্যাকসন খেলাধুলা ও ধাঁধার খেলা শেষে তাদের স্ক্যানিং টুপি খুলে ফেলেছে। এমিলি বলেন, “আমার ছেলেরা এখানে আসতে খুব পছন্দ করে। এখানে খেলনা, বিনামূল্যে স্ন্যাকস, আর অনেক মজার অভিজ্ঞতা আছে। যতদিন ওরা আসতে চাইবে, ততদিন আমি আসব।”
মন্তব্য করুন