বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল। একসময় এই পাখির কিচিরমিচির ডাক ভোরবেলা ঘুম ভাঙাতো গ্রামীণ জনপদের মানুষের। দুই টাকার কাগজের নোটে ছবি থাকলেও বাস্তবে এখন খুব কমই দেখা মেলে এই পাখির। গ্রাম-গঞ্জ, মাঠ-ঘাট, বন-জঙ্গল কিংবা গাছ-লতায় নানা প্রজাতির পাখির দেখা মিললেও চিরচেনা জাতীয় পাখি দোয়েল যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
দোয়েল প্যাসেরিফরম (চড়ুই-প্রতিম) বর্গের অন্তর্গত একটি পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis। এরা মূলত Muscicapidae পরিবারভুক্ত। ফরাসি ভাষায় পাখিটিকে বলা হয় Shama dayal আর ওলন্দাজ ভাষায় এর নাম Dayallijster। দোয়েলের শরীর ছোট ও আকর্ষণীয়। সাদা-কালো রঙের দোয়েলকে সহজেই চেনা যায়। কিচিরমিচির শব্দ, সুমধুর সুরেলা ডাক আর শিষ দিয়ে ডাকার জন্য এই পাখি মানুষের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল কাঠগিরির প্রবীণদের ভাষ্যমতে, কয়েক বছর আগেও ভোরবেলা দোয়েলের ডাকেই ঘুম ভাঙতো তাদের। বিলে-ঝিলে, ঝোপ-ঝাড়ে, গাছের ডালে কিংবা বাড়ির আঙিনায় বসে পাখিরা সুর তুলতো। শুধু দোয়েল নয়, টিয়া, ময়না, কোকিল, শালিক, চড়ুই, ঘুঘু, মাছরাঙা, বক, কাক দেশীয় অসংখ্য প্রজাতির পাখি গ্রামীণ পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তুলতো।
আজ সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। শহর-গ্রাম মিলিয়ে কিছু টিয়া, ঘুঘু বা কাক চোখে পড়লেও জাতীয় পাখি দোয়েল যেন হারিয়ে গেছে মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে।
পাখিপ্রেমী ও পরিবেশবিদরা বলছেন, দোয়েলসহ নানা দেশীয় প্রজাতির পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। এর প্রধান কারণগুলো হলো- নির্বিচারে বন উজাড় ও গাছ কেটে ফেলা, কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, পাখির বিচরণক্ষেত্র ধ্বংস, খাদ্য সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব।
প্রকৃতি ধ্বংসের এসব কারণে পাখির সংখ্যা কমছে। বিশেষ করে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পোকামাকড় ধ্বংস হচ্ছে, যা পাখির প্রধান খাদ্য। ফলে খাদ্যাভাবে পাখি টিকে থাকতে পারছে না।
পাখি শুধু সৌন্দর্য বাড়ায় না, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষা করে দোয়েল ও অন্যান্য পাখি। অথচ বনভূমি ধ্বংস, জমি দখল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার প্রকৃতির এই সহায়ক শক্তিকেই ধ্বংস করছে। এতে পরিবেশ যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি মানুষও বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃতির এক অনন্য সঙ্গী থেকে।
সচেতন মহল বলছে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে জাতীয় পাখি দোয়েলসহ দেশীয় প্রজাতির নানা পাখি একেবারেই হারিয়ে যাবে।
এজন্য করণীয়, কৃষিজমিতে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। বন ও পরিবেশ রক্ষায় কড়া আইন প্রয়োগ করা। সামাজিক বনায়ন গড়ে তোলা। পাখি শিকারীদের আইনের আওতায় আনা। পাখি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
দোয়েল শুধু একটি পাখি নয় এটি বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের অংশ। একসময় গ্রামীণ জীবনের প্রতীক এই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। যদি এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দোয়েলের নাম শুধু বইয়ে পড়বে, প্রকৃতিতে আর দেখবে না। তাই দোয়েলকে বাঁচাতে হলে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে, রক্ষা করতে হবে পরিবেশকে।
মন্তব্য করুন