ঈদুল আজহা শুধু আনন্দের নয়—এটি আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মহা উপলক্ষ। এই ত্যাগ-ভিত্তিক ইবাদতে রয়েছে গরিব-দুস্থ মানুষের অধিকার; তাদের জন্য বরাদ্দ কোরবানির গোশত এবং অবহেলিত একটি অংশ: পশুর চামড়া। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, এ চামড়া কেবল সদকা হিসেবে ব্যবহারযোগ্য, এতে ব্যক্তিগত লাভ গ্রহণ করা জায়েজ নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সদকার হকপ্রাপ্তরা কোথায়? এখন এই চামড়া যাচ্ছে কার হাতে, আর গরিবরা কী পাচ্ছে?
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
হাদিসে এসেছে, ‘যে কোরবানি করবে, সে যেন তার পশুর চামড়ার বিনিময়ে কিছু না নেয় এবং কসাইকে চামড়া দিয়ে পারিশ্রমিক না দেয়।’ (সহিহ বুখারি: ১৭১৭)
এই দিকনির্দেশনাগুলো আমাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, কোরবানির চামড়া ব্যবসার উপকরণ নয়, বরং একটি পবিত্র সদকা। যার মূল উদ্দেশ্য হলো—গরিব, এতিম, অসহায় ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো।
বাস্তব চিত্র ঠিক এর উল্টো। ঈদের দিন গরিব মানুষের এই চামড়া চলে যাচ্ছে একদল অসাধু সিন্ডিকেটের হাতে। তারা দাম নামিয়ে ফেলে। মাদরাসাগুলোতে চামড়া পৌঁছাতে দেয় না। অনেক জায়গায় জোর করে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে অতীতে। একটি মুসলিমপ্রধান দেশে এমন লুটপাট ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে।
গরিব মানুষ বা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না তাদের প্রাপ্য। সদকার অর্থ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীর পকেটে। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় ধসে পড়ছে আস্থা।
চামড়া গরিবের হক—এই হক রক্ষার দায়িত্ব সবার।
চামড়া বিক্রি করে নয়, সরাসরি মাদরাসা বা গরিবকে সদকা দিন। কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে চামড়া দেবেন না।
চামড়া সংগ্রহের সংগঠিত ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা তৈরি করুন। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সিন্ডিকেট প্রতিরোধ গড়ুন।
সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন এবং জাকাত-সদকা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরপেক্ষ নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।
মোটকথা, চামড়ার হকদারদের সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক সংহতি ও সরকারি হস্তক্ষেপ—এই তিনটি পথই হতে পারে চামড়া সিন্ডিকেট রোধ ও সদকার হক রক্ষার বাস্তব উপায়।
হাদিসে এসেছে, ‘মুসলমান কারও হক মেরে থাকলে, কেয়ামতের দিন তাকে তার নেক আমলের বিনিময়ে সেই হক দিয়ে দিতে হবে।’ (সহিহ বুখারি) সুতরাং, চামড়ার হক মেরে ব্যবসা করা শুধু জাগতিক অপরাধ নয়—আখেরাতেও এর ভয়াবহ পরিণতি রয়েছে।
সদকার চামড়া সরাসরি মাদরাসায় বা গরিবদের দিন।
সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
প্রশাসন ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো সমন্বয়ে কাজ করা উচিত।
চামড়ার বাজার নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি স্বচ্ছ ও মানবিক নীতি থাকা জরুরি। নিম্নলিখিত বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকা চাই. ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ: সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার ন্যূনতম দাম ঘোষণা করবে, যাতে গরিব বা মাদরাসা ঠকবে না।.
স্থানীয় সংগ্রহ কেন্দ্র: উপজেলা/ওয়ার্ড পর্যায়ে সরকার অনুমোদিত সংগ্রহ কেন্দ্র গড়া হবে, যেখানে যে কেউ চামড়া জমা দিতে পারবে এবং নির্ধারিত মূল্যে তা বিক্রি হবে।. সিন্ডিকেটবিরোধী নজরদারি: জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় ইমামদের মাধ্যমে বাজার তদারকি
। সিন্ডিকেট প্রমাণ হলে জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিল. দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা: নিবন্ধিত মাদরাসাগুলোর জন্য সরকারি তত্ত্বাবধানে চামড়া বিক্রির ব্যবস্থা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে সরাসরি বিক্রয় সংযোগ করা যায়।.
গরিবদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: কোরবানির আগে গরিব ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রচার। কীভাবে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয় তা শেখানো।
চামড়ার হক গরিবের—এটা কোরআন-হাদিসে স্পষ্ট। কিন্তু এ হক যখন সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে: আমরা কীভাবে একটি ঈমানদার সমাজ গঠন করছি? কোরবানির চামড়া যেন ব্যবসার বস্তু না হয়, বরং সদকার এক পবিত্র আমানত হিসেবে তার যোগ্য প্রাপকের কাছে পৌঁছায়—এটাই হোক আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
মন্তব্য করুন