জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী, টানা আটবার বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে ফিনল্যান্ড। তবে এই সুখ কেবল বাহ্যিক প্রাচুর্য নয়—এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও অভিজ্ঞতা ফিনিশ নাগরিকদের জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ফিনল্যান্ডের মানুষরা ‘সুখ’ শব্দটির বদলে ‘তৃপ্তি’, ‘পরিপূর্ণতা’ কিংবা ‘জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি’—এই শব্দগুলোকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব নিজেও মন্তব্য করেছেন, চিরকাল সুখী থাকা সম্ভব নয়, তবে নিরাপত্তা, স্বাধীনতা এবং সমতা সুখের পথে শুভ সূচনা দিতে পারে।
অবশ্যই, ফিনল্যান্ডে নেমেই কেউ হয়তো সারি সারি হাসিমুখ দেখতে পাবেন না। তবে প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও নাগরিকদের জীবনযাত্রার ভারসাম্য পর্যটকদের মনকে স্পর্শ করে। ট্রাভেল অপারেটররা এই সুখের খ্যাতিকে দেশের পর্যটনে রূপান্তর করতে চাইছেন।
এই সুখের ধারণা শুধু একটিমাত্র বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে নেই। জাতিসংঘের রিপোর্ট তৈরি হয়েছে বৈষম্যের অনুপস্থিতি, সামাজিক সমর্থন, মাথাপিছু জিডিপি, আয়ু, স্বাধীনতা, উদারতা ও ইতিবাচক আবেগ ইত্যাদিকে ভিত্তি করে।
ফিনিশদের মধ্যে জীবনের ভারসাম্য, পরিমিতিবোধ এবং প্রাকৃতিক জীবনধারায় সন্তুষ্ট থাকার মনোভাব স্পষ্ট। তারা বিশ্বাস করেন, ক্রমাগত প্রতিযোগিতার চেয়ে মানসিক শান্তি ও সংযোগ স্থাপন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণাগুলো পর্যটকদের মধ্যেও সাড়া ফেলে।
ফিনল্যান্ডের জনপ্রিয় ‘সওনা’ সংস্কৃতি, স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস, টেকসই জীবনধারা, এবং নিরাপদ পরিবেশ—সবই এই সুখের অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে। সাওনার পর ঠান্ডা পানিতে ডুব দেওয়া, মাশরুম ও বেরি সংগ্রহ, হ্রদের ধারে বনভোজন—সবই মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
‘জোকাইসেনোইকুডেট’ বা ‘এভরিম্যানস রাইট’ নামক আইনের মাধ্যমে ফিনল্যান্ডের যে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে—এটা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ আরও দৃঢ় করে।
এই দেশের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ‘সিসু’—যা ধৈর্য, সাহস, এবং সংকটে দৃঢ়তার নামান্তর। এটি ফিনিশদের মানসিক দৃঢ়তা ও একে অপরকে সহায়তার মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপদ পানীয় জল, গণপরিবহন, লাইব্রেরি—এই মৌলিক সুযোগ-সুবিধাগুলোও নাগরিকদের সুখী রাখে। ফিনল্যান্ডে সুখ মানে কেবল ভোগ নয়, বরং সহজলভ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন।
অবশ্যই, ফিনল্যান্ডও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়—অন্ধকার দীর্ঘ শীতকাল কিংবা অর্থনৈতিক চাপে। কিন্তু তবুও নাগরিকরা তাদের জীবনের ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের সান্নিধ্যে তৃপ্ত থাকেন।
পেনশনভোগী জুহা রোইহার মতে, সুখের মানদণ্ড সবার জন্য এক নয়। তবে তিনি মনে করেন, “আমাদের যা আছে, তা-ই আমাদের সুখের উৎস।” আর এখানেই নিহিত রয়েছে ফিনল্যান্ডের সুখী হবার সত্যিকারের দর্শন।
মন্তব্য করুন