রংপুর অঞ্চলে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ, কম বৃষ্টিপাতের ফলে নাব্য হ্রাস, এবং দখল-দূষণের কারণে এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিবর্তনে রংপুরের পরিবেশও বিপন্ন হতে চলেছে। একসময় প্রমত্তা ছিল এই অঞ্চলের নদীগুলো, অথচ এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
নদীগুলোর তলদেশে চর জেগে ওঠায় স্থানীয়রা সেখানে কৃষিকাজ করছেন। কোথাও কোথাও নদীর মাঝে বাঁধ দিয়ে পানির গতিপথ পরিবর্তন করা হচ্ছে, যার ফলে কৃষকদের বাড়তি পানি সেচ দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে জলজপ্রাণীও বিলুপ্তির পথে, এবং জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের অধীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। যদিও শতভাগ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তবে বর্তমান অবস্থাকে স্থিতিশীল রাখা এবং দখলদার উচ্ছেদ করে নদীর প্রাণ ফেরানো সম্ভব। এতে নদীগুলো বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
রংপুর জেলায় ২৮টি নদ-নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—তিস্তা, বুড়ি তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, চিকলি, শাখা চিকলি, বুল্লাই, টেপরীর বিল, মরা, নলেয়া, মানস, ধুম, খটখটিয়া, বাইশা ডারা, আলাইকুড়ি, বুড়াইল, খোকসা ঘাঘট, আখিরা, ভেলুয়া, কাঠগিরি, নেংটি ছেঁড়া, করতোয়া, সোনামতি, নলশীসা, ধরলা, দুধকুমার, নীলকুমার, ব্রহ্মপুত্র ও মাশানকুড়া।
একসময় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, সদর উপজেলা, কাউনিয়া ও পীরগাছা এলাকায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল মানস নদী। কিন্তু বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময় যেখানে নৌকা চলত, এখন সেখানে কলের লাঙল চলছে। মানস নদীর প্রায় ৫০টি খেয়াঘাট একে একে হারিয়ে গেছে।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর ধরলা, রংপুরের কাউনিয়ার মানস নদী, গঙ্গাচড়ার তিস্তা ও নগরীর ঘাঘট নদীসহ অনেক নদী এখন শুকিয়ে গেছে। কৃষকরা এসব নদীর তলদেশে ধানের বীজতলা তৈরি করছেন। কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর এলাকার কৃষক সহিদুল আলম বলেন, “মানস নদীতে এবার খুব সহজেই বীজতলা তৈরি করা গেছে, কারণ গত বছরের তুলনায় এবার নদীতে পানি অনেক কম ছিল।”
রিভারাইন পিপলের পরিচালক, নদী গবেষক ও অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, একসময় রংপুর অঞ্চলের নদীগুলোতে সারা বছর পানি থাকত। কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট ও যমুনেশ্বরীর বুক চিরে ১২ মাস নৌকা চলত। সেই নদীগুলোর অনেকগুলোই এখন অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে।
গঙ্গাচড়ার কৃষক আজিজার রহমান বলেন, “তিস্তার বুকে এখন বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। যে যেখানে পারছেন, সেখানেই দখল করে কৃষিকাজ করছেন।” একসময় তিস্তার মহিপুর ঘাটে মাঝি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন শমসের আলী। তিনি বলেন, “আমাদের তিন পুরুষের পেশা ছিল মাঝির কাজ করা। কিন্তু এখন তিস্তা নদীর গঙ্গাচড়ায় প্রায় ১৬টি ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে।”
রংপুর অঞ্চলের নদীগুলোকে বাঁচাতে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অবৈধ দখল ও দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
মন্তব্য করুন