পবিত্র কাবা মুসলমানদের হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দু, ইসলামের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান। এটি শুধু একটি স্থাপত্য নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, ইতিহাস ও আত্মত্যাগের জীবন্ত প্রতীক। প্রতিদিন পাঁচবার মুসলিমরা নামাজে এই ঘরের দিকেই মুখ ঘোরান, আর হজ ও ওমরাহর সময় লাখো মানুষ একত্র হয়ে একত্রে ইবাদত করেন।
নিচে কাবা শরিফ সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য, চমকপ্রদ ও কম পরিচিত তথ্য তুলে ধরা হলো, যা প্রতিটি মুসলমানের জানা উচিত।
ইসলামি ইতিহাস অনুযায়ী, কাবা প্রথম নির্মাণ করেন হজরত আদম (আ.)। এরপর হজরত শিস (আ.) কাবা পুনরায় নির্মাণ করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) পরবর্তীতে কাবাকে স্থায়ী কাঠামোতে রূপ দেন।
পবিত্র কো রআনে ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কাবা নির্মাণের দোয়া উল্লেখ আছে- ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের পক্ষ থেকে তা কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।’ (সুরা বাকারা: ১২৭)
মক্কায় নবুয়তের পূর্বেই কুরাইশ গোত্র কাবা পুনর্নির্মাণ করে। তখন হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় গোত্রগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে রাসুলুল্লাহ (স.) নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে সমস্যার সমাধান করেন। এটি ছিল নবীজির নবুয়তের আগের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সর্বশেষ বড় ধরনের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয় ১৯৯৬ সালে, যখন কাবার কিছু পুরোনো পাথর সরিয়ে নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়। এর ভিত্তিও আরও মজবুত করা হয়। সেই সংস্কারে মূল কাঠামোর পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখা হয়।
কাবার পূর্বে দুটি দরজা ছিল—একটি প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি বের হওয়ার জন্য। একটি জানালাও ছিল কাবার গায়ে। বর্তমানে শুধু একটি দরজা রয়েছে, অপরটি গিলাফের নিচে লুকানো।
আব্বাসীয় খেলাফতের সময় থেকে কাবায় কালো রঙের গিলাফ ব্যবহার শুরু হয়। এর আগে সাদা, সবুজ এবং লাল রঙের কাপড়েও কাবা আবৃত থাকত।
৩১৭ হিজরিতে বাহরাইন থেকে আগত ইসমাইলি গোষ্ঠী কারামিতা কাবায় হামলা চালায়, হাজরে আসওয়াদ ভেঙে ফেলে ও কুফায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফত তাদের থেকে পাথর ফিরিয়ে এনে বিশেষভাবে তা জোড়া লাগায়। আজ আমরা যেটি দেখি, তা মূলত ৮টি ভাঙা টুকরোর সমন্বয়ে গঠিত।
মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (স.) কাবার চাবি বনি শায়বা গোত্রের উসমান ইবনে তালহা (রা.)-কে ফেরত দেন। পবিত্র কোরআনেও বলা হয়েছে, ‘আমানত যার, তাকে তা ফেরত দাও।’ আজও এই বংশেরই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কাবার চাবির দায়িত্ব পালন করেন।
বৃষ্টির সময় কাবা চত্বরে পানি জমে গেলে অতীতে মানুষ সাঁতার কেটে তাওয়াফ করত। মক্কার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় এমন দৃশ্য সাধারণ ছিল।
যেহেতু কাবা নিজেই কিবলা, তাই এর ভেতরে প্রবেশ করলে যেকোনো দিকে মুখ করে নামাজ পড়া যায়। পৃথিবীর একমাত্র স্থানে এই বিশেষ সুবিধা রয়েছে।
কাবার দরজা বছরে মাত্র দুবার খোলা হয়—পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধি লাগানোর উদ্দেশ্যে। সৌদি বাদশাহ, রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশেষ অতিথিদের কেবল এটি দেখতে দেওয়া হয়।
কাবার গায়ে যে কালো কাপড়টি থাকে, তা ‘কিসওয়া’ নামে পরিচিত। এটি প্রতি বছর ৯ জিলহজ বদলে দেওয়া হয়। এই কাপড় তৈরি ও রূপায়নে খরচ হয় ৫০ লাখ সৌদি রিয়ালের বেশি।
বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন—কাবার গায়ে মুখ রেখে দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। বিশেষ করে ‘মুলতাজাম’ নামক অংশে দোয়া করার মর্যাদা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পিপাসা মেটাতে জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে যে পানির ঝর্ণা বের হয়, সেটাই আজকের জমজম কূপ। বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর পানিতে জীবাণু নেই এবং দীর্ঘদিন অক্ষুণ্ন থাকে।
ড. মুহাম্মাদ কামাল ইসমাইল ছিলেন কাবা চত্বরের আধুনিক সংস্কার প্রকল্পের প্রধান স্থপতি। তিনি গ্রিস থেকে বিশেষ মার্বেল পাথর সংগ্রহ করেন, যা রোদেও শীতল থাকে। এই পাথর ব্যবহার করা হয় মক্কা ও মদিনার পবিত্র মসজিদ চত্বরের মেঝেতে। এর তাপপ্রতিরোধী গুণে প্রচণ্ড গরমেও মুসল্লিরা আরামে চলাফেরা করতে পারেন। পাথরের এই বৈশিষ্ট্য ও নির্মাণশৈলী চত্বরকে আরামদায়ক রাখে, যা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন হিসেবেও বিবেচিত।
পবিত্র কাবা শুধু ইতিহাস নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর আস্থা, ঐক্য ও আত্মার প্রতীক। এর প্রতিটি ইট, পাথর, কাঠামোর পেছনে রয়েছে বিস্ময়কর ইতিহাস ও আল্লাহর কুদরত। এ সম্পর্কে জানা মানেই ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা।
মন্তব্য করুন