উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট, বামপন্থি বিদ্রোহী থেকে জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠা হোসে “পেপে” মুজিকা ৮৯ বছর বয়সে মারা গেছেন। উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওর্সি মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বার্তায় তার মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন। ২০২৪ সালে মুজিকার গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে এবং তার মৃত্যুর পর ওর্সি গভীর শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, “গভীর দুঃখের সঙ্গে আমাদের সহকর্মী পেপে মুজিকার মৃত্যু ঘোষণা করছি। আপনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, এবং আপনার মানুষদের প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তার জন্য ধন্যবাদ।”
হোসে মুজিকা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে উরুগুয়ে পরিবেশবান্ধব সংস্কার, সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেওয়া, এবং গাঁজা ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার পথে এগিয়ে যায়। তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন তার সরল জীবনধারার জন্য। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ও বিলাসবহুল প্রাসাদ ছেড়ে রাজধানী মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে একটি ছোটখাটো ফুলচাষের খামারে বাস করতেন। ২০২২ সালে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতি যদি বিলাসে ডুবে যায়, তা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতিবিদদের দেশের সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করা উচিত, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের মতো নয়।”
মুজিকার মৃত্যুর পর লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন বামপন্থি নেতারা তাকে স্মরণ করে শোক প্রকাশ করেছেন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম তার শোকবার্তায় লেখেন, “আমাদের প্রিয় পেপে মুজিকার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। তিনি তার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সরলতার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের জন্য এক উদাহরণ হয়ে ছিলেন।” চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিচও শোক প্রকাশ করে লেখেন, “আপনি আমাদের এমন একটি আশা দিয়ে গেছেন, যে সবকিছু আরও ভালোভাবে করা সম্ভব।”
মুজিকা ছিলেন সেই প্রজন্মের একজন প্রতীক, যারা ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি তুপামারোস নামের এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন, যারা ব্যাংক ডাকাতি, শহর দখল এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। তাকে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয় এবং প্রায় এক দশক একা কারাবন্দি থাকতে হয়।
১৯৭৩ সালে উরুগুয়ে সেনা অভ্যুত্থানে এক বর্বর সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়, যেখানে গুম, নির্যাতনসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত হয়। তবে ১৯৮৫ সালে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটে এবং মুজিকা ও অন্যান্য বিদ্রোহীরা সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। এরপর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং কেন্দ্র-বাম জোট “ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও”তে যোগ দেন।
৭৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি গর্ভপাত ও সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেন, গাঁজা বৈধকরণে নেতৃত্ব দেন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দেন, যা পরিবেশ নিয়ে উরুগুয়েকে অগ্রণী অবস্থানে নিয়ে যায়। তার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি, যিনি তুপামারোস আন্দোলনের সময়েই তার সঙ্গে পরিচিত হন, তিনিও সক্রিয় রাজনীতিক ছিলেন এবং পরে মুজিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হন।
মুজিকা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে একটি সাধারণ খামারে বাস করতেন, চালাতেন পুরনো একটি নীল রঙের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ি, যা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত করেছিল। ২০২২ সালে আল জাজিরাকে তিনি বলেছিলেন, “আমরা একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করি, আর যেন রাজা নির্বাচন করি — লাল গালিচা, প্রাসাদ, রাজকীয় আচরণ।”
প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পরও তিনি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং উরুগুয়ের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। ২০২৪ সালে তিনি রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সমস্যা হলো, দুনিয়া চালায় বৃদ্ধরা, যারা ভুলে যায় তারা কখনো তরুণ ছিল।”
মুজিকা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের চিকিৎসায় ক্যানসার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জানা যায় যে এটি তার যকৃতে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, “সত্যি বলতে, আমি মরতে চলেছি। তবে একজন যোদ্ধার বিশ্রাম নেওয়ার অধিকার তো থাকেই।”
মন্তব্য করুন