যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দ্বিতীয় দফার আলোচনা করে ‘খুব ভালো অগ্রগতি’ অর্জন করেছে বলে দাবি করেছে ওয়াশিংটন। শনিবার, রোমে ওমানের মধ্যস্থতায় চার ঘণ্টার এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উভয় পক্ষ আবারও আলোচনার জন্য সম্মত হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তার ভাষায়,
“আজ (শনিবার) রোমে চার ঘণ্টাব্যাপী আমাদের দ্বিতীয় দফার সরাসরি ও পরোক্ষ আলোচনায় আমরা খুব ভালো অগ্রগতি করেছি।”
ইরানের প্রধান আলোচক আব্বাস আরাগচি ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে জানান,
“এই বৈঠকে আমরা কিছু মূলনীতি ও লক্ষ্য নিয়ে আরও ভালো বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে পেরেছি।”
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকাই বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই কারিগরি পর্যায়ের পরোক্ষ আলোচনা আবার শুরু হবে এবং আগামী শনিবার (২৬ এপ্রিল) তা শীর্ষ আলোচনা পর্যায়ে উন্নীত হবে। তবে মার্কিন পক্ষ দিন বা স্থান নির্দিষ্ট করেনি। ওমান জানায়, তৃতীয় দফার আলোচনা মুসকাটে অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রথম দফার বৈঠক হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে।
২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি পরিত্যাগ করার পর, এটি প্রথম এমন উচ্চপর্যায়ের আলোচনা। পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ—ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে, যদিও তেহরান সবসময় বলেছে, তার কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক।
ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আরাগচি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ একটি ‘ন্যায্য, দীর্ঘস্থায়ী ও বাধ্যতামূলক সমঝোতায়’ পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন, যাতে ইরান পরমাণু অস্ত্র থেকে মুক্ত থাকে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে।
ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আল বুসাইদি বলেন,
“আলোচনায় গতি এসেছে এবং এখন এমন অনেক কিছু সম্ভব হচ্ছে যা এক সময় অচিন্তনীয় ছিল।”
বাকাই জানান, আলোচনায় দুই প্রতিনিধি আলাদা কক্ষে ছিলেন এবং ওমানি দূতাবাসে বুসাইদি বার্তাবাহক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফেরার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ’ কৌশল চালু করেন এবং মার্চে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে চিঠি লিখে নতুন করে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানান। তবে, একইসঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকিও দেন।
বৃহস্পতিবার ট্রাম্প বলেন,
“আমি সামরিক বিকল্প ব্যবহার করতে মরিয়া নই। আমি মনে করি, ইরান আলোচনায় আসতে চায়।”
ইরানের পক্ষ থেকে আরাগচি বলেন, প্রথম দফায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছুটা আন্তরিকতা দেখা গেলেও তাদের ‘উদ্দেশ্য ও প্রেরণা নিয়ে সন্দেহ’ রয়েছে।
জাতিসংঘের পরমাণু তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা আইএইএ-র প্রধান রাফায়েল গ্রোসি ফরাসি সংবাদপত্র ল্য মুন্দ-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরান এখন ‘পরমাণু বোমা অর্জনের খুব কাছাকাছি।’
২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সরে যাওয়ার পর এক বছরের জন্য ইরান তার প্রতিশ্রুতি মেনে চললেও পরে ধীরে ধীরে তা থেকে সরে আসে। বর্তমানে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত ৩.৬৭ শতাংশ সীমার অনেক উপরে, যদিও এখনো অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশে পৌঁছায়নি।
শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইউরোপীয় দেশগুলোকে আহ্বান জানান—২০১৫ সালের চুক্তির অধীনে ‘স্ন্যাপব্যাক’ ব্যবস্থা সক্রিয় করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, যার মাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হবে। এই ব্যবস্থাটি সক্রিয় করার সময়সীমা অক্টোবরে শেষ হবে।
ইরান আগেই সতর্ক করেছিল, ‘স্ন্যাপব্যাক’ চালু হলে তারা পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে আসতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই আলোচনায় ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে তার মিলিশিয়া-সমর্থনের বিষয়টিও তুলতে পারে। তবে আরাগচি জানান,
“এই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কেবল পরমাণু ইস্যু নিয়েই কথা বলেছে।”
তিনি স্পষ্ট করে দেন, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার ‘আলোচনার বাইরে’ এবং এটি কখনো বন্ধ করা যাবে না, যদিও উইটকফ এই সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধের আহ্বান জানিয়ে এসেছেন।
এদিকে ইসরাইল আবারও ঘোষণা করেছে, তারা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র অর্জন করতে দেবে না। শনিবার প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন,
“আমি এক চুলও পিছু হটবো না। এই বিষয়ে আমি আপসহীন।”
মন্তব্য করুন