উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রামের বুক চিরে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষণস্থায়ী দ্বীপচর। কিন্তু এ চরগুলোর আয়ুষ্কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। নদীর এক প্রান্তে চর জেগে উঠলেও অন্য প্রান্তে গিলে খায় ভয়াবহ ভাঙন। প্রতি বছরই ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাজারো বসতবাড়ি, চাষের জমি ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে দুই হাজারেরও বেশি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের পূর্ব গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা শওকত আলী (৬০) ও তাঁর স্ত্রী ছলিমা বেগম (৫০)। দীর্ঘ ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁরা অন্তত ১০ বার ব্রহ্মপুত্র ভাঙনের মুখোমুখি হয়েছেন। সম্প্রতি উজানের ঢলে নদীর পানি বেড়ে নতুন করে ভাঙন দেখা দিলে আবারও বসতি হারাতে হয় এই দম্পতিকে। বর্তমানে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন চর পার্বতীপুর গ্রামে।
ছলিমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নদীভাঙনে ফসলি জমি, বাড়িঘর সবই চলে গেল। কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। একসময় কয়েক বিঘা জমির মালিক ছিলাম, আর এখন বাড়ি করার জমিও নেই। ব্রহ্মপুত্র হামাক নিঃস্ব করে দিল।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদীর ভাঙনে ১৫ হাজার পরিবার বসতবাড়ি হারিয়েছে। চলতি বছরেই কেবল ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সদর, উলিপুর, চিলমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় ৪৪৭টি পরিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ও সোনাপুর এলাকায় শতাধিক পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। রাজারহাটে তিস্তার ভাঙনে ৬৩টি এবং ফুলবাড়ীতে ধরলার ভাঙনে ৬টি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকে অন্যের জমিতে কিংবা রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় বহু পরিবার কষ্ট করে অন্য জেলায় চলে যাচ্ছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভগবতীপুর এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে স্থানীয় একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন ভাঙনের কবলে। এছাড়া পাঁচগাছি ইউনিয়নের পূর্ব গোবিন্দপুর এলাকায় প্রায় ৫০০ মিটারজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত ১৫ দিনে অন্তত ২৫টি পরিবার তাদের বসতি হারিয়েছে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, যেকোনো সময় নদী গিলে নিতে পারে দুটি মসজিদ, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগের একমাত্র সেতুটি।
স্থানীয় বাসিন্দা আদম আলী (৬০) বলেন, ‘আমার জীবনে কতবার যে নদী ভাঙল তার হিসাব নেই। এবারও সবাই বাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে গেছে। আমি ২০ বছরের পুরনো ভিটে ফেলে যেতে চাই না। কিন্তু নদী এখন আঙিনায় চলে এসেছে। যেকোনো দিন সব নিয়ে যাবে।’
চর গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম জানান, একসময় এই গ্রাম ছিল উঁচু ভূমি। আশপাশের চরের কৃষকরা এসে এখানে ফসল ফলাতো, ছেলে-মেয়েরা থেকে পড়াশোনা করত। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন সেই চিত্র বদলে দিয়েছে। এখন গ্রামটির মানুষকেই আশ্রয়ের জন্য অন্য চরে ঘুরতে হচ্ছে।
পাঁচগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল বাতেন সরকার জানান, সাম্প্রতিক ভাঙনে তাঁর ইউনিয়নের ছয়টি পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে জমা দেওয়া হয়েছে। ভাঙন চলমান থাকায় আরও অন্তত ১৫০ পরিবার ঝুঁকির মধ্যে আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের অন্তত পাঁচটি স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এর মধ্যে তিনটি পয়েন্টে প্রতিরোধমূলক কাজ চলছে। পাঁচগাছি ও যাত্রাপুরের আরও দুইটি পয়েন্টে দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
কুড়িগ্রামের মানুষের জীবন ও জীবিকা বারবার নদীভাঙনে বিপর্যস্ত হচ্ছে। জমি-জিরাত হারিয়ে তারা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছেন, অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে প্রতিবছর একই চিত্র দেখতে হচ্ছে। তাই তাঁরা নদীভাঙন মোকাবিলায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন