পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা মানবজীবনের জন্য দিকনির্দেশনা। এর মধ্যে সুরা ত্বহার ২৫-২৮ আয়াতে হজরত মুসা (আ.)-এর যে দোয়া বর্ণিত হয়েছে, তা সব যুগের মানুষের জন্য সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মুসা (আ.) দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর মাদইয়ানে থাকার পর ফিরে যাচ্ছেন এমন এক শাসকের (ফেরাউন) সামনে, যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ প্রভু’ দাবি করত। মুসা (আ.) জানতেন, এটি হবে জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। তার জিহ্বায় সামান্য তোতলামি ছিল (কিছু আলেম বলেন, শৈশবে আগুনের কয়লা মুখে দেওয়ার কারণে)।
এই পরিস্থিতিতে তিনি আল্লাহর কাছে করলেন এক অনন্য প্রার্থনা— رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ • وَ يَسِّرْ لِيْ أَمْرِيْ • وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِيْ • يَفْقَهُوْا قَوْلِيْ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ (হৃদয়) প্রশস্ত করে দাও, আমার কাজ সহজ করে দাও, আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও—যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা ত্বহা: ২৫-২৮)
দোয়ার চারটি অংশে গভীর শিক্ষা
১. رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ হৃদয় প্রশস্ত করার প্রার্থনা
ধৈর্য, সাহস, প্রশান্তি ও আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি বা অতিরিক্ত মানসিক চাপের সময়ে মনোবল ধরে রাখার জন্য এটি বিনীত প্রার্থনা। রাসূলুল্লাহ (স.)ও কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে বক্ষ প্রশস্ত করার দোয়া করতেন।
২. وَ يَسِّرْ لِيْ أَمْرِيْ কাজ সহজ করার আবেদন
এই অংশে স্বীকার করা হয় যে, আল্লাহই সব কাজের নিয়ন্ত্রক; তাঁর সাহায্য ছাড়া কিছুই সহজ হয় না। গ্লোবাল সার্ভেতে ৮৯% মানুষ কাজের জটিলতায় মানসিক চাপে ভোগে। তাই বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, পরীক্ষা বা ইন্টারভিউর আগে এই দোয়া অন্তত ৩ বার পড়া যেতে পারে।
৩. وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِيْ বাকশক্তি উন্মুক্ত করা
স্পষ্টভাবে কথা বলার ক্ষমতা নেতৃত্ব, দাওয়াত ও শিক্ষায় অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫% পেশাদার সাফল্য নির্ভর করে কার্যকর যোগাযোগের ওপর। তাই এই অংশটি সরকালের জন্য উত্তম প্রার্থনা।
৪. يَفْقَهُوْا قَوْلِيْ যেন তারা বুঝতে পারে
শুধু সুন্দরভাবে বলা নয়, বরং শ্রোতার মনে বার্তা পৌঁছানোই আসল উদ্দেশ্য। আধুনিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ করে অনলাইন ক্লাস, ওয়েবিনার, দাওয়াত প্রোগ্রামে বার্তা কার্যকরভাবে পৌঁছানোর জন্য এই অংশটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
পেশাগত জীবনে প্রয়োগ
ইন্টারভিউ ভীতি: প্রস্তুতির সাথে এই দোয়া সাফল্যের হার অনেক বাড়াতে পারে।
টিম কনফ্লিক্ট: ‘রব্বিশরাহলি সাদরি’ নিয়মিত পড়লে টিমের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রেজেন্টেশন অ্যাংজাইটি: বাকশক্তির জড়তা কাটিয়ে দক্ষতা বাড়িয়ে উপস্থাপনার জন্য মুসলিম জীবনে দোয়াটির বিকল্প নেই।
জীবনে প্রয়োগের রুটিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে ৭ বার পড়ুন। দিনটা প্রশান্তভাবে শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।
কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে ৩ বার পড়ুন। মানসিক প্রস্তুতির জন্য উপকারী।
স্ট্রেস বা ভয় লাগলে একাগ্রচিত্তে দোয়াটি পড়লে ইনশাআল্লাহ হৃদয় প্রশস্ত হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
বিশেষ সতর্কতা
দোয়া পড়ার পর নিজের প্রচেষ্টা বাদ দেওয়া নয়।
শুধু মুখস্ত করে অর্থ বুঝে না পড়া ঠিক নয়।
ফল পেতে দেরি হলে হতাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহ সঠিক সময়ে সর্বোত্তম ফল দেন।
এটি শুধু মুসা (আ.)-এর দোয়া নয়; বরং প্রতিটি মানুষের জন্য এক আধ্যাত্মিক টুলকিট। জীবনের প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে যখন মনে হবে, ‘আমি পারব না’, ঠিক তখন এই দোয়াটি পাঠ করে স্মরণ করুন- ‘যিনি এই দোয়া শিখিয়েছেন, সেই আল্লাহই আপনার হৃদয় প্রশস্ত করবেন, কাজ সহজ করবেন, বাকশক্তি উন্মুক্ত করবেন এবং আপনার বার্তা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেবেন।
মন্তব্য করুন