২০২৪ সালের জুলাই মাসে ফরিদপুর রূপ নেয় প্রতিবাদের নগরীতে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। এই আন্দোলনে নারীরা শুধু অংশই নেননি, নেতৃত্ব দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধের প্রতীক।
১০ জুলাই ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বের হওয়া মিছিল শহরের সুপার মার্কেটের সামনে চার রাস্তার মোড় অবরোধ করে। সেদিন পুলিশের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। বরং কোতোয়ালী থানার ওসি মো. হাসানুজ্জামান গরমে ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের সেভেন আপ পান করান। কিন্তু ২৬ দিন পর, ৫ আগস্ট, এই ওসির থানার সামনেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সামসু মোল্লা (৫৯)—ফরিদপুরের কোটা আন্দোলনের একমাত্র শহীদ।
ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশের নীরবতা
১৬ জুলাই সকালে ব্রাহ্মসমাজ সড়কে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রলীগের ৫০-৫৫ জন সদস্য। মুখে কালো কাপড়, হাতে লাঠি-সোঁটা নিয়ে হামলায় নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত বিশ্বাস। মাত্র ৫০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি হাসানুজ্জামান ও তার সহকর্মীরা হামলা থামাতে কোনো ব্যবস্থা নেননি। ছয় শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।
নারীরা রুখে দাঁড়ায়
১৮ জুলাই জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের হামলায় আহত হন বহু নারী। এক গর্ভবতী নারীকে পেটানোর ফলে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়। কিন্তু এরপরই নারীরা সিদ্ধান্ত নেন—”এবার রক্তের বদলা নিতে হবে সাহসে।”
৩১ জুলাই: সাদা পোশাকে বিপ্লব
গোয়ালচামট এলাকায় স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা সাদা ইউনিফর্ম ও ড্রেস পরে জড়ো হন। হাতে পোস্টারে লেখা—“রক্তের দাগ শুকায় নাই”, “জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব, আসছে ফাগুন, আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব”। তাদের মিছিলে অংশ নেন স্থানীয়রাও। এক পর্যায়ে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দখল করে নেয় এই নারী বাহিনী।
৩ আগস্ট: রক্তঝরা প্রতিরোধ
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়া মিছিলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। তখন ৭০ বছরের এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বলেন, “তোরা মার ওগো! আমি মরি সমস্যা নাই।” তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে ইট তুলে দেন। সংঘর্ষে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতারা পালিয়ে যান। পুলিশ লাইনস স্কুলের এক ছাত্রীর রক্তাক্ত মুখের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
আটকের রাত, জেগে ওঠার সকাল
৩ আগস্ট রাতে শতাধিক শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু পরদিন সকালেই গোয়ালচামটে আবার জড়ো হন নারীরা। তাদের স্লোগান—“ভয়ের ভিত গুঁড়িয়ে দেব”, “রক্ত দিয়ে হোক নতুন সকাল”। ওই দিনই জনতা পুড়িয়ে দেয় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, পুলিশ বক্স ও ছাত্রলীগ অফিস। এক ছাত্রলীগ নেতা গুলি চালালেও আন্দোলন থামেনি।
এক নেত্রীর কথা
রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী কাজী জেবা তাহসিন বলেন, “জুলাই আমাকে শিখিয়েছে—ভয় পেলে চলবে না। ১৮ জুলাই ডিসি অফিসের সামনে পুলিশের লাঠিচার্জ দেখেছি, গর্ভবতী এক বোনের গর্ভপাতের খবর শুনেছি। হুমকি পেয়েও থামিনি। ৩ আগস্ট টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় চোখে কিছু দেখতে পাইনি, কিন্তু শুনেছি অজ্ঞান হয়ে পড়ার শব্দ। আজও সেই অপরাধীদের বিচার হয়নি। কিন্তু আমি জানি, একদিন না একদিন জেগে উঠবে মানুষ।”*
ফরিদপুরের জুলাই আন্দোলন শুধু একটি প্রতিবাদ নয়, তা হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নারীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক গণজাগরণ। যেখানে বৃদ্ধার ইট আর তরুণীর রক্তাক্ত মুখ হয়ে উঠেছিল পরিবর্তনের প্রতীক।
মন্তব্য করুন