কেউ এটাকে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার সমাপ্তি বলছেন, আবার কেউ বলছেন এটি এক বৃহৎ পুনর্বিন্যাস। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্য এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। যখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে শত্রু হিসেবে না দেখে, বরং অংশীদার বা অন্তত নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করবে, তখন ঠিক কী ঘটতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা এখনও এই পরিবর্তনটি পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করছেন।
একজন মার্কিন কূটনীতিক যখন জানতে পারেন যে, ইসরাইল ট্রাম্প প্রশাসনকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে যাতে রাশিয়া সিরিয়ায় তার সামরিক ঘাঁটি রাখতে পারে, তখন তিনি বলেন, “এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি হবে।” কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যদি ট্রাম্প এই কথার সঙ্গে একমত না হন, তখন তিনি নীরব থাকেন।
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে “অবিশ্বাস্য সুযোগ” খুঁজে দেখতে চান। গত শুক্রবার তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, “রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ, ইউক্রেনের তুলনায়।” যদিও যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে আসছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে রাশিয়াকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু এখন ট্রাম্প প্রশাসন সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চাইছে। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ট্রাম্প আসলে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের চীন-কূটনীতির পথ অনুসরণ করছেন—যেভাবে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে ফেলতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিলেন।
তবে সাবেক মার্কিন কূটনীতিক চাস ফ্রিম্যান মনে করেন, এটি ভুল তুলনা। তার মতে, “ট্রাম্পের পুতিনের প্রতি উন্মুক্ততা নিক্সনের চীন নীতির মতো নয়, বরং এটি মিশরের আনোয়ার সাদাতের জেরুজালেম সফরের মতো।”
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকজন উপদেষ্টা তুরস্ককে একটি প্রধান হুমকি হিসেবে দেখছেন। ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন সম্প্রতি বলেছেন, “এরদোগান বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক নেতা এবং তিনি ওসমানীয় সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান।”
ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, সিরিয়ায় আসাদ সরকার পতন আসলে তুরস্কের “শত্রুতামূলক দখল” ছাড়া কিছু নয়। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ড বলছেন, “ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চান। আমার চিন্তা-ভাবনা বলছে, সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইসরাইল একসঙ্গে কাজ করবে, যাতে তুরস্কের প্রভাব কমানো যায়। আর ট্রাম্প বলবেন, ‘আমি পরোয়া করি না, তোমরা তুরস্কের সঙ্গে যা খুশি করো।’”
এদিকে, ট্রাম্প চান ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন একটি চুক্তি করতে। মস্কো তো ইতোমধ্যে এই আলোচনায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের গবেষক আন্না বোরশচেভস্কায়া বলছেন, “২০১৫ সালের চুক্তিতে রাশিয়ার মধ্যস্থতার জন্য ওবামা প্রশাসন অনেক ছাড় দিয়েছিল। তবে এতে রাশিয়া মূলত ইরানের পক্ষে কাজ করেছে।”
তবে সাবেক মার্কিন কূটনীতিকরা মনে করেন, রাশিয়ার ভূমিকা এবার সীমিত থাকবে। রবার্ট ফোর্ড বলছেন, “ওবামার সময় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ট্রাম্পও হয়তো একইভাবে চলবেন।”
এমন পরিস্থিতিতে যদি ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হয় এবং ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, তাহলে উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতিতে তা বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এতদিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু যদি নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, তাহলে রাশিয়া সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারে, ফলে আমিরাতের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়বে।
তাছাড়া, রাশিয়া উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রির চেষ্টাও করতে পারে।
এদিকে, ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সৌদি আরবে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, রিয়াদ আগামী চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে রাজি হয়েছে।
ট্রাম্পের বক্তব্য অনুযায়ী, “তারা এই বিনিয়োগে রাজি হয়েছে, তাই আমি সেখানে যাচ্ছি… সম্ভবত আগামী দেড় মাসের মধ্যে।”
কূটনৈতিক বিশ্লেষক চাস ফ্রিম্যান সতর্ক করে বলেছেন, “বিশ্বব্যবস্থা নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু এটি কোন দিকে মোড় নেবে, তা কেউ জানে না। এটি অনেকটা ক্যালেইডোস্কোপের মতো— দুটি অংশ একসঙ্গে ধাক্কা লাগলেই নতুন এক আকৃতি তৈরি হয়।”
এমন একটা অবস্থায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি সহযোগিতা না হলেও, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো অনেক বিষয়ে নীরব থেকে রাশিয়াকে জায়গা ছেড়ে দেবে।
মন্তব্য করুন