কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি 

হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে কিভাবে সংগ্রাম করে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হয় তার জলন্ত উদাহরণ কুড়িগ্রামের মীম। একদিকে বিয়ের চাপ অপরদিকে অর্থকষ্টে থাকা। পকেটে টাকা না থাকায় রোজা করে দিন পার করা। এমন অসম্ভব প্রতিকূলতার মাঝে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে অদম্য মেধাবী মীম। সে এখন কোচিং করছে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্বপ্নপূরণ করার জন্য।
এদিকে দিনমজুর বাবার পক্ষে পড়াশুনার খরচটা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হওয়ায় প্রতিবেশীদের চাপে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন বাবা মতিয়ার রহমান। কিন্তু মেধাবী মীমের ইচ্ছে পড়াশুনা চালিয়ে গিয়ে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়ার। ফলে মামার কাছে কান্নাকাটি করে বিয়ের সিদ্ধান্তটা ঠেকিয়ে দেয়ায় আজ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে প্রতিবেশীসহ দরিদ্র বাবা-মাকে চমকে দিয়েছে মাছুমা আক্তার মীম। তার পড়াশুনাটা চালিয়ে যাওয়াটা এখনো মসৃন নয়। বাবার দিমজুরের টাকায় চলে সংসার। ৮শতক বাড়িভিটা ছাড়া কোন জমিজমা নেই। ফলে দুইবোন, একভাইসহ ৫জনের খাবার জোটাতে হিমসীম অবস্থা। সেখানে মেয়েকে পড়াবেন কিভাবে। কিন্তু মীমের অদম্য মেধাই তাকে নানান দুর্ভোগ আর অর্থকষ্টের মধ্য দিয়েই দেখাচ্ছে আলোকবর্তিতা!
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাগভান্ডার সোনাতলি এলাকার দিনমজুর পরিবারের মেয়ে মাছুমা আক্তার মীম। পরিবারের কেউ এসএসসি’র গন্ডি পেরুতে না পারলেও এই পরিবারের বড় মেয়ে মীম একে একে সব ক্লাসেই ভাল ফলাফল করে যখন এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেল। তখন এলাকার সবার চক্ষু চড়কগাছ! কিন্তু পাস করলেই তো হবে না, মেয়েকে পড়াবে কিভাবে! দিনমজুর পরিবারে টানাটানির সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। সবাই সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও মীমের জন্য সেটা ছিল অসম্ভব একটা ব্যাপার। তারপরও মেয়ের ইচ্ছের কারণে এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা লোন করে মেয়েকে রংপুরে ভার্সিটি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য কোচিং-এ ভর্তি করানো হলো। এরপর মীমের জীবনে শুরু হলো নতুন এক সংগ্রাম। রংপুরে ম্যাচ ভাড়া, যাতায়াত ও তিনবেলা খাবারের টাকা জোগাবে কে? কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে খেয়ে না খেয়ে চলছে মীমের সংগ্রামী জীবন।
মীমের মা আয়েশা খাতুন জানান, মেয়েটা আমার অনেক কষ্ট করেছে। জুতা দিতে না পারায় শিক্ষকরা ক্লাসে ঢুকতে দেয়নি। ঋণ করে জুতো কিনে দিয়েছি। ড্রেস কিনে দিতেও কষ্ট হয়েছে, অনেক সময় যাতায়াতের টাকা দিতে পারিনি, মেয়ে ৩ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে স্কুলে গেছে ও-আসছে। ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে পারিনি। তারপরও মেয়েটি ভাল রেজাল্ট করেছে। আমাদের গরীবের ঘরে এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! ওর স্বপ্ন যেন পূরণ হয় এই দোয়াই করি।
মীমের বাবা মতিয়ার রহমান জানান, মেয়ে জিপিএ-৫ পাওয়াতে আমি ভীষণ খুশি। এখন রক্ত বিক্রি করে হলেও মেয়েকে পড়াবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে বিসিএস দিতে চায়, আমিও তাই চাই।
মাছুমা আক্তার মীম জানায়, টেস্ট পরীক্ষা দেয়ার পর আমার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সবাই বলছিল মেয়ে ১৫/১৬ বয়স হয়েছে এখন বিয়ে দেয়া দরকার। এসময় আমি খুব কান্নাকাটি করলাম। মামাকে কেঁদে কেটে বলায়, মামা বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে আটকে দেয়। আমার বাবাও কিছুটা রাজি ছিল, তারা ছেলে দেখতে যাচ্ছিল! আমার কান্নাকাটি আর মামার অনুরোধের কারণে আমার বিয়েটা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমার পরিবার আমার পাশে আছে। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক কষ্ট করে এই পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এমনও হয়েছে রংপুরে মেসে থাকাকালিন খাবারের টাকা দিতে না পারায় রোজা রাখতে হয়েছে। এমন কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পড়াশুনাটা কতদূর চালিয়ে যেতে পারবে, সেটাই এখন চ্যালেঞ্জের। এ কারণে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবণায় কাটছে মীমের দিনগুলো।
মীমের শিক্ষক ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের কৃষি শিক্ষা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো. সফিয়ার রহমান জানান, মীম গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থী। পরিবারে নাজুক অবস্থা। সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাকে সহযোগিতা করা হলে মেয়েটি নির্বিঘে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে। তার সহযোগিতা দরকার।
(মীমের সাথে যোগাযোগ নাম্বার: ০১৩২৮৭২৯৯০৫।)
মন্তব্য করুন