কাশ্মিরে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, ভারত-শাসিত কাশ্মিরের পাহেলগাম শহরে এক সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। এই ঘটনার পর থেকেই উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যা একটি বড় ধরনের সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কাশ্মিরে হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নয়াদিল্লি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে—৬০ বছরের পুরোনো সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা, বাণিজ্য ও ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করা, সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা এবং পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা কমিয়ে আনা।
ভারতের এসব পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি—যা দেশের শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংস্থা—একই ধরনের কড়া সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আকাশসীমা ও বাণিজ্য স্থগিত করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়, যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি।
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাত মাস পর, ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের শিমলা শহরে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল—দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, সীমান্ত-সংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা এবং কাশ্মির ইস্যুকে আন্তর্জাতিক নয়, বরং শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এটি দুই দেশকে সীমান্ত পরিস্থিতি একতরফাভাবে না বদলানো এবং একে অপরের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ না করারও অঙ্গীকার করায়।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সূফির মতে, শিমলা চুক্তি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের একটি মৌলিক কাঠামো। এটি বাতিল করতে গেলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণভাবে গভীর মূল্যায়ন প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে, ভারত দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘ প্রস্তাবের চেয়ে শিমলা চুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে এবং দাবি করেছে, কাশ্মির এখন কেবল একটি দ্বিপাক্ষিক ইস্যু।
বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মুশতাক আহমদের মতে, পাকিস্তান বরাবরই শিমলা চুক্তিকে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তগুলোর ভিত্তি হিসেবে দেখেছে, এবং কাশ্মির সংকটের আন্তর্জাতিক সমাধানে গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১৯ সালে ভারত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করলে, পাকিস্তান তা এই চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে।
শিমলা চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়েছে—সিয়াচেন হিমবাহ দখল থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ তার উদাহরণ। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লার মতে, যদি শিমলা চুক্তি বাতিল হয়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ঘিরে একটি "ওপেন সিজন" শুরু হবে, যেখানে অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যাবে। তবে চুক্তি বাতিল মানেই সরাসরি যুদ্ধ নয়, বরং তা যুদ্ধের আশঙ্কাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।
যদিও পাকিস্তান শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে, এখনো তা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করেনি। বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান এতে বহুপাক্ষিক আলোচনার পথে ফেরার সুযোগ খুঁজছে। চুক্তি বাতিল হলে জাতিসংঘের মাধ্যমে কাশ্মির ইস্যু আবার আন্তর্জাতিক মঞ্চে আনার পথ খুলে যেতে পারে।
এ ছাড়া ভারত যদি সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে, তবে সেটি পাকিস্তানের জন্য একটি বিপজ্জনক আগ্রাসী পদক্ষেপ হবে। কারণ, ইন্দুস, ঝিলম ও চেনাব নদীর পানি পাকিস্তানের কৃষি ও জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
শিমলা চুক্তি শুধু দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি রূপরেখা নয়, বরং কাশ্মির ইস্যুতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ সীমিত রাখার একটি কাঠামোও। চুক্তি বাতিলের হুমকি কৌশলগতভাবে পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরির একটি সুযোগ। তবে এই চুক্তি কার্যত বাতিল হলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এক অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক পথে প্রবেশ করতে পারে।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.