ছয় দশক আগে পাকিস্তানের সঙ্গে করা সিন্ধুর পানির বণ্টন চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। কাশ্মিরের পেহলগামে হামলার প্রতিক্রিয়ায় এসেছে এই ঘোষণা।
নয়া দিল্লি বলেছে, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধে পাকিস্তানকে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে এই চুক্তি স্থগিতই থাকবে।
এটিকে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলা চলে। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরের পর থেকে যুদ্ধ, সংঘাত, কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেও সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি টিকে ছিল। এই চুক্তির সেই স্থিতিশীলতা এখন প্রশ্নের মুখে।
নয়া দিল্লির সিদ্ধান্ত প্রতিবেশী দুই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ভাগ করার ক্ষেত্রে একটি মোড় চিহ্নিত করে, যেখানে পাকিস্তানের নদী, ফসল, মানুষের ওপর এর বড় প্রভাব।
বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় বহু বছরের আলোচনার পর ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে টেকসই আন্তঃসীমান্ত নদী সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর একটি।
এটি সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীকে দুটি দেশের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। ভারত পূর্ব দিকের তিনটি নদী রবি, বিয়াস ও শতদ্রু পেয়েছে। পাকিস্তান পেয়েছে পশ্চিমের তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব; যা অববাহিকার মোট পানির ৮০ শতাংশ জোগান দেয়।
এই চুক্তির আওতায় উজানের দেশ ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সীমিত সেচের মতো কাজে পশ্চিমের নদীগুলো ব্যবহারের অধিকার রাখে। তবে সেই কাজটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে নদীর প্রবাহ ঘুরে না যায়।
পাকিস্তানের জন্য চুক্তি অনেক বড় কিছু। এটি একটি সম্পূর্ণ সেচ এবং পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয়।
চুক্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি স্থায়ী প্রক্রিয়াও রয়েছে। চুক্তির আওতায় গঠিত সিন্ধু কমিশন তা করে। সেখানে প্রতিটি দেশ থেকে একজন করে কমিশনার রয়েছেন, যারা তথ্য আদান প্রদান, নতুন প্রকল্প পর্যালোচনা এবং নিয়মিত বৈঠক করেন।
বিরোধ দেখা দিলে তা প্রথমে কমিশনের কাছে যায়, অমীমাংসিত পার্থক্যগুলো নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয় এবং আইনি বিরোধ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে পাঠানোর সুযোগ রয়েছে, যেখানে বিশ্ব ব্যাংক একটি ভূমিকা পালন করে।
ভারতের বাগলিহার ও কিষাণগঙ্গা বাঁধ নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এই প্রক্রিয়াটি আগে ব্যবহার করা হয়েছে।
চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এর মেয়াদ শেষের কোনও তারিখ রাখা হযনি। স্থগিতের কোনও বিধানও রাখা হয়নি।
চুক্তিপত্রের দ্বাদশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে এটি কেবল পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেই সংশোধন করা যেতে পারে, যদিও তা কখনোই ঘটেনি।
নয়া দিল্লির ঘোষণার পর এই প্রশ্ন সবার আগে আসে- ভারত কি কেবল পাকিস্তানে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে পারে? স্বল্প মেয়াদে, এর সহজ উত্তর হল না। বিশেষ করে উচ্চ প্রবাহের মৌসুমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে এমন মাত্রায় নয়।
সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব বিশাল নদী। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বরফ গলার ফলে এই নদীগুলো কয়েক বিলিয়ন ঘন মিটার পানি বহন করে।
এই নদীগুলোতে উজানে ভারতে কিছু অবকাঠামো রয়েছে, যার মধ্যে বাগলিহার ও কিষাণগঙ্গা বাঁধ রয়েছে। তবে এর কোনোটিই বিপুল পরিমাণ পানি ধরে রাখার মতো শক্তিশালী নয়। ভারত যদি তার বিদ্যমান সমস্ত বাঁধের জল ছেড়েও দেয়, তাও তাতে মোট প্রবাহের সামান্যই পরিবর্তন ঘটবে।
ভারত ইতোমধ্যেই চুক্তির অধীনে বরাদ্দকৃত পূর্বের নদীগুলোর বেশিরভাগ জল ব্যবহার করে, তাই সেই নদীগুলোতে যেকোনো নতুন পদক্ষেপে ভাটি অঞ্চলে সীমিত প্রভাব পড়বে।
তবে পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের বিষয় হল শুষ্ক মৌসুমে কী ঘটবে, যখন অববাহিকায় পানির প্রবাহ কম থাকে। তখন চুক্তির অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হতে শুরু করতে পারে।
মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। ভারত যদি চুক্তি কাঠামোর বাইরে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এটি নতুন অবকাঠামো উন্নয়নের দরজা খুলে দেবে। যা পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ওপর ভারতের কর্তৃত্ব তৈরি করবে।
তবে সেই কাজটিও সহজ নয়। যেকোনো বড় আকারের বাঁধ বা জলপথ পরিবর্তন প্রকল্পের নির্মাণে বহু বছর সময় লাগবে। আর ভারতীয় কাশ্মীরে তেমন স্থান সীমিত এবং তা করা ভূতাত্ত্বিকভাবে চ্যালেঞ্জিং। এর খরচ হবে বিশাল, তা রাজনৈতিকভাবেও হবে ঝুঁকিপূর্ণ।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে ভারত যদি পশ্চিমের নদীগুলোতে পানি ধরে রাখার মতো কিছু করে, তবে তা সম্ভাব্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করবে। আর স্যাটেলাইটের যুগে এই ধরনের কাঠামো গোপনে তৈরি করাও সম্ভবপর নয়।
আবার চেনাব বা ঝিলমের মতো নদীতে পানি ধরে রাখতে গেলে ভারতে নিজস্ব উজানের অঞ্চলগুলোতেও বন্যার ঝুঁকি থাকে।
সিন্ধু অববাহিকা থেকে সম্পূর্ণরূপে জল সরিয়ে ভারতের অন্যান্য অংশে নিয়ে যাওয়ার ধারণাটির জন্য বিশাল অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন হবে।
আবার এই ধরনের পদক্ষেপ ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীনের পদক্ষেপ মোকাবেলায় ভারতের অবস্থানকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে।
ভারতের পদক্ষেপে সার্বিক সীমাবদ্ধতা সামনে এলেও চুক্তি সুরক্ষার বিষয়টি এখনও গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ এই নয় যে একদিন বাদেই পানি আসা বন্ধ হয়ে যাবে, বরং কারণটি হলো যে তা অনিশ্চয়তার জন্য তৈরি করা হয়নি।
সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাবের প্রবাহ পাকিস্তানের কৃষি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। আর এই মুহূর্তে পাকিস্তানের কাছে এর কোনও বিকল্প নেই।
ভারতের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য সুদূরপ্রসারী হতে পারে। পাকিস্তানের সেচ ব্যবস্থা বিশ্বের বৃহত্তম সেচ ব্যবস্থাগুলোর একটি, আর এটি পশ্চিমের নদীগুলোরর ওপর নির্ভরশীল। কৃষকরা সেই প্রবাহের উপর ভিত্তি করে তাদের বীজ বপনের পরিকল্পনা করে।
এই নদীগুলোর পানির ওপর খালগুলোও নির্ভরশীল, সেই ছন্দে সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটলেও সেচের পানি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করবে।
সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হল স্থিতিশীলতার অভাব। পাকিস্তানে আসা পানির মোট পরিমাণ এখনই পরিবর্তিত না হলেও তাতে সামান্য পরিবর্তনও বাস্তব সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পানি প্রবাহের হেরফের গম উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাসের জের এখনই টানতে হচ্ছে সিন্ধু ব-দ্বীপকে। নতুন অনিশ্চয়তা অবনতিশীল সেই পরিস্থিতিতে ত্বরান্বিত করতে পারে, যার ফলে উপকূলীয় জীবিকার ওপর প্রভাব পড়বে।
পশ্চিমের নদীগুলো পাকিস্তানে পানির প্রধান উৎস। এই নদীগুলি দেশজুড়ে জীবন, জীবিকা এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যকে টিকিয়ে রাখে। পাকিস্তানের জন্য তাই পানি প্রবাহ অব্যাহত থাকা খুবই জরুরি।
তারপর রয়েছে বিদ্যুৎ। পাকিস্তানের বিদ্যুতের এক-তৃতীয়াংশ জলবিদ্যুৎ থেকে আসে। উজানের প্রবাহ হ্রাস পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
পাকিস্তান পানি ঘাটতির দেশ। এই ঘাটতি নিয়েই দীর্ঘকাল চালিয়ে এলেও এখন অনিশ্চয়তার নতুন একটি স্তরের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
সিন্ধু পানি চুক্তি তার স্থায়িত্বের জন্য প্রশংসিত হলেও গত দশক ধরেই চাপের মধ্যে রয়েছে।
২০১৩ সালে একটি সালিশি আদালত পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেয় এবং ভারতকে কিষাণগঙ্গা প্রকল্পের ভাটিতে ন্যূনতম প্রবাহ ছেড়ে দিতে এবং জলাধারের জলস্তর হ্রাসের সীমা জোরদার করতে বাধ্য করে।
কিন্তু ২০১৬ সালের উরি হামলার পর সেই ধারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ভারত নিয়মিত সহযোগিতা স্থগিত করে, দীর্ঘকাল ধরে স্থগিত রাখা বাঁধ প্রকল্পের দ্রুত অনুমোদন শুরু করে এবং পানিকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনার হাতিয়ার করে।
তখনও ভারত বলেছিল যে তারা চুক্তির মধ্যে থেকেই কাজ করবে। কিন্তু ২০২৩ সালে সেটিও পরিবর্তিত হতে শুরু করে, যখন ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বাদশ অনুচ্ছেদের ৩ ধারা (যে বিধান অনুসারে কেবল পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেই চুক্তি সংশোধন করা যায়) প্রয়োগ করে এবং জলবায়ু পরিবর্তন, জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা এবং পাকিস্তানের বাধার কারণ দেখিয়ে চুক্তি পর্যালোচনার অনুরোধ করে। পাকিস্তান পর্যালোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
পরবর্তী মাসগুলোতে উভয় দেশই নিজ নিজ অবস্থান মজবুত করতে সচেষ্ট হয়। ভারত বাঁধ নকশার প্রযুক্তিগত প্রশ্ন পর্যালোচনার জন্য একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের সন্ধান করে; পাকিস্তান একটি সালিশি আদালতের দিকে অগ্রসর হয়।
ভারতের সাম্প্রতিক ঘোষণায় ১৯৬০ সালের পর এই প্রথম চুক্তির বাইরে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এটি একটি দর কষাকষির কৌশল নাকি স্থায়ী বিচ্ছেদ, তা এখনও দেখার বাকি।
সিন্ধুর পানি বণ্টন চুক্তি নিখুঁত নয়, তবে এটি একটি সফল চুক্তির উদাহরণ হিসাবে স্বীকৃত। সেই কাঠামোটিই এখন চাপের মধ্যে। চুক্তিটি টিকে থাকবে, নাকি পর্যালোচনা হবে, নাকি কার্যত বিবর্ণ হতে দেওয়া হবে, এর পরের পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে।
সিন্ধু এবং এর উপনদীগুলি হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে, এখন দুটি আধুনিক পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সহযোগিতা করার ক্ষমতা পরীক্ষা করছে।
আগামী মাস ও বছরগুলোতে প্রকাশ পাবে যে এক্ষেত্রে বিচক্ষণতার জয় হবে, নাকি উপমহাদেশ তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ পািন নিয়ে একটি অনিশ্চিত যুগে প্রবেশ করবে।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.