আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল সমীকরণে কূটনৈতিক তৎপরতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন ধারা ভারতকে এক ধরনের কৌশলগত সংকটে ফেলেছে। জাপানের প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরেছে।
যদিও ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক জটিল ও সংবেদনশীল, সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠক এই ঘনিষ্ঠতার একটি মাইলফলক।
এরপর, ২০২৩ সালের নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিয়মিত কার্গো শিপিং রুট চালু হয় এবং ডিসেম্বরে সাত বছরের বিরতির পর পুনরায় সরাসরি ফ্লাইট চালু করা হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যৌথ পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মূল পণ্য ছিল তুলা ও পাট। তবে সম্প্রতি দুই দেশই নতুন খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।
জাপান সফরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কারখানার অবকাঠামো থাকলেও উৎপাদন স্বল্পতার কারণে চিনি আমদানি করতে হয়। পাকিস্তানের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি বাংলাদেশের কারখানাগুলো আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যোগাযোগ বাড়ছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করে এবং যৌথ সামরিক মহড়া ও অস্ত্র স্থানান্তর নিয়ে আলোচনা করে। পাশাপাশি, পারস্পরিক বৃত্তি কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বিনিময়ও শুরু হয়েছে। এছাড়া, ঢাকায় পাকিস্তানের একজন খ্যাতনামা শিল্পীর পরিবেশনা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গভীর করেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, যেখানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বাংলাদেশে আজও গভীর ক্ষত হিসেবে বিরাজমান।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় এসে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনে তার কর্তৃত্ববাদী নীতি জনগণের ক্ষোভ সৃষ্টি করে, যা ভারতের প্রতিও প্রসারিত হয়।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা না করলেও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে উদ্যোগ নিয়েছে।
ড. ইউনূস সম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ক ২০১৬ সালের পর থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, মূলত ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে।
বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে সার্ক গঠনের ধারণা দেন। তবে ভারত শুরুতে সন্দেহপ্রবণ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে শেষ পর্যন্ত এতে যোগ দেয়। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে নির্ধারিত সার্ক সম্মেলনে ভারত ও বাংলাদেশ অংশ না নেওয়ায় এটি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এরপর ভারত এবং শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ বিমসটেক-এর দিকে মনোযোগ দেয়।
কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সার্ক পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা ভারতকে কূটনৈতিক সংকটে ফেলতে পারে। কারণ, ভারত সার্ক পুনরায় সক্রিয় করতে রাজি হবে না যতক্ষণ না পাকিস্তানের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।
বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় সার্ক পুনরুজ্জীবিত করা ভারতের জন্যও একটি কৌশলগত উপযোগী হতে পারে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে থাইল্যান্ডে নির্ধারিত বিমসটেক সম্মেলন হবে ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির প্রথম মুখোমুখি বৈঠকের সম্ভাব্য ক্ষেত্র। এই সম্মেলনে ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং সার্ক পুনরুজ্জীবনে তাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের জন্য নতুন কৌশলগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে, সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা ভারতকে কূটনৈতিকভাবে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করতে পারে। এখন দেখার বিষয়, ভারত এই পরিস্থিতিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসে।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.