
বর্তমান সময়ে মানুষ দিন দিন নিজের ভেতর থেকে, প্রকৃতি থেকে এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অস্থির ও কৃত্রিম সময়ের ভিড়ে লোকসংগীতই পারে মানুষকে মানবিক করতে এমন বিশ্বাস থেকেই নরওয়ের নাগরিক, কবি ও গবেষক উয়েরা সেথে প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মায়ের তরী’। আধুনিক সংগীতের ভিড়ে লোকগানের এমন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ইতোমধ্যেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে।
‘মায়ের তরী’ গুরুগৃহের নয়টি কেন্দ্রে বর্তমানে দুই জেলার প্রায় ৬০০ জন শিশু শিক্ষার্থী শিখছে লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়াসহ বিভিন্ন ধারার লোকগান। পাশাপাশি তারা শিখছে বাঁশি, একতারা, দোতারা, খমোক, তবলা, বেহালা ও বাংলাঢোলসহ ঐতিহ্যবাহী লোকবাদ্যযন্ত্র বাজানোর কৌশল।
ভোরের কুয়াশায় ঘেরা ধানের খেত পেরিয়ে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের শিতলীরপাঠ গ্রামের শিশুরা হাতে একতারা নিয়ে দৌড়ায় গুরুগৃহের পথে। দূর থেকে ভেসে আসে গান “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।” সেই সুরে মিশে আছে কুড়িগ্রামের আকাশ, নদী আর মানুষের প্রাণ।
এই গুরুগৃহে শিশুদের গান ও বাদ্যযন্ত্রে তাল মেলান গুরু নারায়ণ চন্দ্র রায় ও তাঁর সহযোগীরা। তিনি বলেন, আমাদের গুরুগৃহে শিতলীরপাঠ ও আশপাশের প্রান্তিক গ্রামের শিশুরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে লোকগান শেখে। এখানে শেখা অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করছে। শহরের শিশুদের মতো প্রান্তিক শিশুরাও সংগীতে এগিয়ে যেতে পারছে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
‘মায়ের তরী’র পরিচালক সুজন কুমার বেদ জানান, ২০১৬ সালে নরওয়ের কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক উয়েরা সেথে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে নয়টি গুরুগৃহে ৬০০ শিশু নিয়মিতভাবে লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শেখছে।
উয়েরা সেথে প্রায় তিন দশক আগে বাংলা লোকসংগীতের প্রেমে পড়েন। ১৯৯৮ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন বন্যা–দুর্গত মানুষের জীবন দেখতে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজের চরে। সেখানেই নারীদের মুখে শোনেন মারফতি ও মুর্শিদী গান। সেই সুর তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লোকগানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক।
লোকগানের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি অনুবাদ করেন ৫৩টি লালনগীতি, যা পরে প্রকাশিত হয় ‘The Mystic Songs of Lalon’ নামে নরওয়েজিয়ান ভাষায়। বইটি উত্তর ইউরোপের পাঠকদের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে লালনের মানবতাবাদী দর্শন।
উয়েরা বলেন, লালনের গান অনুবাদ করা সহজ ছিল না। এর ভেতরে আছে আধ্যাত্মিকতা, মানবপ্রেম, সমাজ সমালোচনা। আমি চেয়েছি নরওয়ের মানুষ বুঝুক বাংলার মাটিতে কত গভীর মানবতার সুর বেজে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, আজকের পৃথিবীতে মানসিক শান্তি পাওয়া কঠিন। মানুষ ছুটছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা জানে না। লোকসংগীত শুধু গান নয়, এটি আত্মার এক সাধনা। যা মানুষকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে আনে, মানবিক করে তোলে।
কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটসহ চরাঞ্চলে এখন ‘মায়ের তরী’ গুরুগৃহ এক চলমান উৎসবের মতো। নদীর ধারে, খোলা আকাশের নিচে, মেঠোপথের বাঁকে চলে সুরের আসর। শিশুরা গেয়ে ওঠে “মনরে তুই জান না নিজের পরিচয়।”
স্থানীয় শিক্ষক মমতাজুল হক বলেন, এই উদ্যোগে চরের মানুষ নিজের সংস্কৃতির গর্ব ফিরে পেয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা বুঝছে লোকগান কোনো পুরোনো জিনিস নয়, এটাই আমাদের আত্মার ভাষা।
ছিনাই ইউনিয়নের আদুরী রাণী বলেন, আমার দুই মেয়ে এখানে গান শেখে। বড় মেয়ে রংপুর বেতারে লোকগান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ‘মায়ের তরী’ না থাকলে আমরা কখনও এমন স্বপ্ন দেখতাম না।
সংগঠক ইউসুফ আলমগীর বলেন, মায়ের তরী’ কেবল একটি সংগঠন নয়, এটি এক দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসে, তবে সে মানুষকেও ভালোবাসতে শেখে। আমাদের কাজ সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আনা। লালনের ভাষায় ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ সেই মানুষ হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য।
বর্তমানে সংগঠনটি গ্রামীণ বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে শিশুদের জন্য ‘লোকগান শিক্ষা কর্মসূচি’ পরিচালনা করছে। সপ্তাহে শুক্রবার ও শনিবার নিয়মিতভাবে চলে লোকসংগীতের কর্মশালা, যেখানে স্থানীয় শিল্পীরা শিশুদের হাতে কলমে শেখান সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো।
এভাবেই উত্তরবঙ্গের গ্রামবাংলায়, শিশুদের কণ্ঠে, একতারা ও দোতারার সুরে নতুন করে জেগে উঠছে বাংলার মাটির গান লোকগানের সুরে মানবতার নবজাগরণ ঘটাচ্ছে ‘মায়ের তরী’।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.