নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর চারজন খুলাফায়ে রাশেদিন ইসলামী শাসনের বিস্তার ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে শত শত চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। এসব চুক্তি ছিল লেভান্ট, হিজাজ ও পারস্যের মতো ইসলাম বিজিত ভূখণ্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের জনগণের সঙ্গে সম্পাদিত। খুলাফায়ে রাশেদার আমলে ইসলামী রাষ্ট্র অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি অর্জন করে, বিশেষ করে উমর (রা.)-এর খিলাফতের সময়ে। তাঁর নেতৃত্বে ইসলামী শাসন শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়; ন্যায়, ইনসাফ ও ধর্মীয় সহাবস্থানের দিক থেকেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
এর মধ্যে সবচেয়ে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ‘উমরের চুক্তি’, যা সম্পাদিত হয়েছিল জেরুজালেমের (বায়তুল মুকাদ্দাস) অধিবাসীদের সঙ্গে। চুক্তির মূল বক্তব্য হলো—
‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে। আমিরুল মুমিনিন, উমর আল-খাত্তাব আলিয়ার (জেরুজালেমের) অধিবাসীদের জন্য এই নিরাপত্তা ঘোষণা করছেন। তিনি তাদের জীবন, সম্পদ, গির্জা ও ক্রুশের নিরাপত্তা প্রদান করেছেন।
তাদের গির্জাগুলো দখল করা হবে না, ধ্বংস করা হবে না; তাদের ক্রুশ কিংবা সম্পত্তির কোনো ক্ষতি করা হবে না। তাদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হবে না এবং তাদের কারো প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করা হবে না। এই ঘোষণার ওপর রয়েছে আল্লাহর অঙ্গীকার, তাঁর রাসুল (সা.)-এর অঙ্গীকার, খলিফাদের অঙ্গীকার এবং সব মুমিনের অঙ্গীকার।’
এই চুক্তি ইতিহাসে ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
এটি ছিল ইসলামী সভ্যতার উদারতা, ন্যায়বিচার ও সহনশীলতার অনন্য দলিল। এই ঐতিহাসিক চুক্তি থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা আছে—
১. সহনশীলতা ও উদারতার শিক্ষা : উমর (রা.) এই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নয়, বরং ইসলামের সহনশীলতা ও মানবিক নীতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য। তিনি চাইলে জেরুজালেম তথা সমগ্র লেভান্ট অঞ্চলকে খ্রিস্টানদের উপস্থিতি থেকে মুক্ত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং তিনি তাদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।
২. মুসলিম ও অমুসলিমদের শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থান : উমর (রা.)-এর চুক্তি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সব মানুষের জন্য ন্যায় ও শান্তির ধর্ম।
চুক্তিতে বলা হয়েছে—‘তাদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হবে না এবং তাদের কাউকেও কোনোভাবে ক্ষতি করা হবে না।’ এর মাধ্যমে ইসলাম অমুসলিমদের ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা রক্ষা করেছে। এই ঘোষণা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানরা দীর্ঘ যুগ ধরে এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করেছে।
৩. উমর (রা.)-এর দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা : জেরুজালেম বিজয়ের পর যখন উমর (রা.) শহরে প্রবেশ করেন, তখন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নেতা তাঁকে তাদের গির্জার ভেতরে নামাজ পড়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন, যদিও শরিয়ত অনুসারে গির্জার ভেতরে নামাজ পড়া বৈধ ছিল। উমর (রা.) বলেছিলেন, ‘আমি এখানে নামাজ পড়লে হয়তো ভবিষ্যতে কোনো মুসলিম এই গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করার দাবি করতে পারে। তাই আমি বাইরে নামাজ পড়ব।’
৪. উমর (রা.)-এর বিনয় ও সরলতা : বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও উমর (রা.) জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিলেন এক নিঃস্ব, বিনয়ী মানুষের মতো। তিনি একটি সাদা উটে চড়েছিলেন, তাঁর পোশাকে ছিল প্যাঁচ এবং পাশে ছিলেন তাঁর দাস। কখনো দাস উটে চড়তেন, উমর হেঁটে যেতেন, আবার কখনো উল্টোটা। এ দৃশ্য দেখে খ্রিস্টান নেতারা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ভাষায়, ‘যদি এমন শাসকরা রাজত্ব করে, তবে পৃথিবীতে কেউই তাদের পরাজিত করতে পারবে না।’
৫. মুসলমানদের চুক্তি রক্ষার অঙ্গীকার : উমর (রা.)-এর এই চুক্তি শুধু তখনকার একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল না, বরং মুসলমানরা যুগে যুগে এই চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে। চুক্তিভঙ্গ ইসলামী নীতির পরিপন্থী, এমনকি জেরুজালেমের খ্রিস্টানরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে মুসলমানরা তাদের প্রতিশ্রুতি ও নিরাপত্তা চুক্তি আজও সম্মানের সঙ্গে মেনে চলে আসছে।
৬. পবিত্র ভূমির নিরাপত্তা ও সতর্কবার্তা : উমর (রা.) জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য চুক্তিতে এক বিশেষ শর্ত অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন—ইহুদিদের, যারা আগে বহুবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল, তাদের এই ভূমিতে বসবাস বা যাতায়াত করতে নিষিদ্ধ করা হয়। এটি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং ইসলামী ভূমির নিরাপত্তা রক্ষার প্রতি গভীর সচেতনতার প্রমাণ বহন করে।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.