বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে রাজশাহী কলেজের নাম গৌরবময়ভাবে উচ্চারিত হয়। প্রায় দেড়শো বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিদ্যাপীঠ দেশের রাজনীতির নানা বাঁকেই নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে। অথচ আজ এই প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বহু বছর ধরে নেই কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র হলেও রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে নতুন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর প্রকাশ, নেতৃত্ব বিকাশ আর ন্যায্য দাবিদাওয়ার সাংগঠনিক কাঠামো যেন বিস্মৃত এক অধ্যায় হয়ে গেছে।
রাজশাহী কলেজে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। অথচ তাঁদের সমস্যা, অভিযোগ কিংবা উন্নয়নমূলক চাহিদার বিষয়গুলো তুলে ধরার মতো কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি নেই। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতে, নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় প্রশাসন এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নেয়। এতে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যাগুলো অগ্রাহ্য থেকে যায়।
৮০ ও ৯০ এর দশক পর্যন্ত নিয়মিতই হতো রাজশাহী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ভোটের মৌসুমে পুরো ক্যাম্পাস সরগরম থাকত পোস্টার, প্রচারণা আর উত্তেজনায়। নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে আসত নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রশাসনিক অনীহা ও সময়ের নানা টানাপোড়েনে সেই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না, তাঁদের কলেজে কখনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো।
রাজশাহী কলেজে প্রতিনিধিত্ব দরকার এখনই, দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার বললেন, আমরা লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে টয়লেট সংকট অসংখ্য সমস্যায় ভুগি। এসব সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কেউ কথা বলছে না। একটা নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকলে অন্তত আমাদের সমস্যার কথা জোরালোভাবে জানানো যেত।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহজাবিন রহমান বলেন, আমরা ডাকসু-জাকসু নিয়ে সংবাদে পড়ি, কিন্তু আমাদের কলেজে কেন এমন নির্বাচন হয় না সেটা বোঝা যায় না। প্রশাসন চাইলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।
গণতান্ত্রিক চর্চা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমিত থাকা উচিত নয়। কলেজ পর্যায়েও নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, নেতৃত্ব বিকাশ এবং সাংগঠনিক দক্ষতার সুযোগ পাবে বলছেন শিক্ষার্থীরা।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মেশকাত রহমান মনে করেন, নির্বাচন হলে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে। ছাত্ররাজনীতির ইতিবাচক দিক আমরা কাজে লাগাতে পারব। নেতৃত্ব বিকাশের জন্য এটাই সবচেয়ে জরুরি প্ল্যাটফর্ম।
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুস সামাদ বলেন, কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা খেলাধুলার আয়োজন খুবই সীমিত। নির্বাচিত সংসদ থাকলে এগুলো নিয়মিত করা যেত। আমাদের সৃজনশীল বিকাশও হতো।"
রাজনৈতিক সংগঠন গুলো ও বলছে অনতিবিলম্বে দরকার রাজশাহী কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক খালিদ বিন ওয়ালিদ আবির বলেন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক চর্চা রক্ষায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। তিনি অভিযোগ করে বলেন,"আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। ডাকসু-জাকসুর মতো কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন রাজশাহী কলেজে হতে দেওয়া যাবে না।
আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের রাষ্ট্রনেতা। তাঁদের নেতৃত্বগুণ বিকাশের জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ দরকার। রাজশাহী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই সুযোগ করে দিতে পারে।
এ বিষয়ে রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্র শিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান মাসুম বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়েই নয়, বরং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিকাশেও বড় ভূমিকা রাখবে। অতীতে এ কলেজ থেকেই অনেক খ্যাতিমান নেতা উঠে এসেছেন ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। সেই ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচন জরুরি।
কলেজ কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক হলেও বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক সহিংসতা। তাঁর মতে, নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা অপরিহার্য।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. যুহুর আলী বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাত্রনেতা তৈরি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। তবে এই মুহূর্তে কলেজ পর্যায়ে আমরা নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। সরকারি বা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে তখনই আমরা প্রস্তুত হব। জাতীয় নির্বাচন শেষে বিষয়টি নতুনভাবে আলোচনায় আসতে পারে।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.