সকালবেলার স্নিগ্ধ আলো নদীর পানিতে পড়ছে, তবে দৃশ্যটা সৌন্দর্যের চেয়ে ভয়াল। ব্রহ্মপুত্রের খাড়া পাড় গিলে নিচ্ছে গাছপালা, ঘরবাড়ি আর মানুষের স্বপ্ন। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার চর যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়াপাড়ায় নৌকায় শুয়ে ছোট্ট ছেলে পারভেজ নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স মাত্র আট, কিন্তু তার চোখে বয়সের চাইতে অনেক বড় প্রশ্ন- আবার যদি ভেঙে যায়, আমরা কোথায় যাবো?
পারভেজের শৈশব ভাঙনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। জন্মের পর থেকে তিনবার তাদের বাড়ি ভেঙে গেছে। কৃষক বাবা রহিম শেখের জমিও নদীতে হারিয়েছে। এখন তারা মাঝচরে অস্থায়ী কুঁড়েঘরে থাকে। ভাঙন তাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়, নিয়মিত স্কুলে যাওয়া আর নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ।
দুজন ছেলে একসাথে বসে তারা পারভেজ এবং সিয়াম। পারভেজের বন্ধু সিয়ামের বাড়িও ছিল একই গ্রামে। হঠাৎ এক বর্ষায় সিয়ামের পুরো গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখন তাদের বসত আলাদা, তবে বন্ধুত্ব অটুট। প্রতিদিন তারা দেখা করে, খেলে, হাসে। দু’জনের চোখে এখনো স্বপ্ন আছে, কিন্তু সেই স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে আছে নদীর স্রোতের ভয়।
গত শুক্রবার সরজমিনে বানিয়াপাড়ায় গেলে দেখা গেল ভাঙনের বিভীষিকাময় চিত্র। নদীর খাড়া পাড় হু-হু করে ভাঙছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত এক মাসে অন্তত ১০০ পরিবার নদীপাড় ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
সত্তরোর্ধ্ব আদম আলী বলেন, আমার ভিটে আমি পনেরো বার সরিয়েছি। পুরোনো ভিটার মায়া কাটাতে পারিনি, তাই এখনো ব্রহ্মপুত্রের পাড়েই পড়ে আছি।
নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো শুধু মাথার উপর থেকে ছাদ হারাচ্ছে না, হারাচ্ছে আয়ের একমাত্র উৎস কৃষিজমি। ফসলি জমি নদীতে বিলীন হওয়ায় হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। জমি হারিয়ে কৃষকরা দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে।
কৃষি হারালে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শুধু পরিবার নয়, গোটা জেলার অর্থনীতি। খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে, বাজারে পণ্য সরবরাহে চাপ বাড়ছে। একসময় কৃষি নির্ভর কুড়িগ্রামের অর্থনীতি ভাঙনের ধাক্কায় ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ভাঙনে শুধু ভিটেমাটি নয়, শিক্ষাও হারানোর পথে। যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভাগবতীপুরের একমাত্র মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে। স্কুলটি হারালে শত শত শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদীর ভাঙনে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার বসতবাড়ি হারিয়েছে। শুধু চলতি বছরেই ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে সদর, উলিপুর, চিলমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় ৪৪৭টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে।
রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ও সোনাপুরে শতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়েছে। রাজারহাটে তিস্তার ভাঙনে ৬৩ পরিবার, ফুলবাড়ীতে ধরলার ভাঙনে ৬ পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে। এই পরিবারগুলো এখন অন্যের জমি, বাঁধ বা রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীভাঙন প্রতিরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ, নদী ড্রেজিং এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় কুড়িগ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।
পারভেজ ও সিয়াম এখনো হাসিমুখে খেলে, ছোট্ট স্বপ্ন বুনে। কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রশ্ন- আগামীকাল আমাদের ঘর কোথায় হবে?
কুড়িগ্রামের ভাঙন শুধু ঘরবাড়ি গিলে খাচ্ছে না, গ্রাস করছে কৃষিজমি, অর্থনীতি আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন। কুড়িগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে নদীভাঙন ঠেকানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.