আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম মাধ্যম ‘মুরাকাবা’। মুরাকাবা এক সুফিবাদী পরিভাষা। পবিত্র কোরআন হাদিসে মুরাকাবার মৌলিক সূত্র রয়েছে। মুরাকাবার ধারণা স্পষ্ট হয় মহান আল্লাহর তিনটি গুণবাচক নাম থেকে।
যেমন—আলিমুন (সর্বজ্ঞাত), বাসিরুন (সর্বদ্রষ্টা), সামিউন (সর্বশ্রোতা)।
ইবাদতে পূর্ণতার জন্য হাদিসের নির্দেশনা ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো; আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে তিনি তোমাকে দেখছেন (বুখারি)।’ অন্ধ ভিক্ষুকের প্রতি আমাদের মায়াবী আকর্ষণের কারণ ভিক্ষুকের চোখ নয়, পোশাক বা ছিদ্র থালার দিকে আমরা তাকাই না, বরং তার সমর্পণ ও আকুতির কারণে আমরা তাকে সাহায্য করি, তেমনি ইবাদতের ক্ষেত্রে বান্দার সমর্পণ ও অসহায়ত্বই মুরাকাবার মর্মকথা।
হেরা গুহা এমন স্মৃতিবাহী স্থান, যেখানে মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বমানবতার মুক্তি অন্বেষায় নবুয়ত-পূর্বকালে ১৫ বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন।
দীর্ঘ এ সাধনার পরই কোরআন নাজিলের শুভ সূচনা ৬১০ খ্রিস্টাব্দ। এখানেও পাওয়া যায় মুরাকাবার তাৎপর্যগত নির্দেশনা।
মুরাকাবা অর্থ সঙ্গী হওয়া। সুরা হাদিদের ঘোষণা ‘তিনি তোমাদের সঙ্গেই আছেন তোমরা যেখানেই থাকো না কেনো’ (আয়াত : ৪)।
অর্থাৎ ‘মহান আল্লাহর সার্বক্ষণিক সান্নিধ্যের জ্ঞান ও বিশ্বাস, তিনি তার ভেতর ও বাহির সম্পর্কে অবগত। এ জ্ঞান ও বিশ্বাসের প্রতিফলন হলো, মহান আল্লাহ বান্দার সঙ্গী, তিনি তাকে দেখেন, তার কথা শোনেন, তার প্রতিমুহূর্তের কাজ সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন।’ (ইবনুল কায়্যিম (রহ.), মাদারিজুস সালিক)
মুরাকাবার মাধ্যমে বান্দার নাফস মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে।
এতে বান্দা তাঁর স্মরণে আনন্দ, ইবাদত, আনুগত্যে পরিতৃপ্তি ও উৎসাহ পায়। মহান আল্লাহর ঘোষণা ‘তার অপেক্ষা ধর্মে উত্তম কে, যে সৎকর্মপরায়ণ (তাওহিদবাদী) হয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১২৫)
পবিত্র কোরআনে আরো আছে, ‘আর জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা জানেন। কাজেই তাঁকে ভয় করো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৩৫)
আরো আছে, ‘আর যে সৎকর্মপরায়ণ হয়ে নিজেকে আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করে, সে তো দৃঢ়ভাবে ধরল এক মজবুত হাতল।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ২২)
পালাবে কোথায় বান্দা; মহান আল্লাহর নজরদারির বাইরে যেতেও সে অক্ষম! বর্ণিত আছে, জুলায়খা যখন ইউসুফ (আ.)-কে নির্জনে পেল, তখন দাঁড়িয়ে গেল এবং ঘরে সংরক্ষিত মূর্তির চেহারা ঢেকে দিল। ইউসুফ (আ.) বললেন, ‘তুমি কি একটি নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ দেখবে বলে লজ্জা পাচ্ছো? তবে আমি মহাপরাক্রমশালী বাদশাহর নজরদারিতে লজ্জা পাবো না কি?’
প্রসঙ্গত আবদুল্লাহ ইবন দিনার বলেন, ‘আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সঙ্গে মক্কার উদ্দেশ্যে বের হলাম এবং পথিমধ্যে আমরা বিশ্রামের জন্য অবস্থান করলাম, অতঃপর পাহাড় থেকে এক রাখাল আমাদের কাছে এলো; উমর (রা.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন : হে রাখাল! ছাগলের পাল থেকে একটি ছাগল আমাদের কাছে বিক্রি করো। রাখাল বলল, ছাগলের মালিক সে নয়।
তখন উমর (রা.) বললেন : তুমি তোমার মালিককে বলবে ছাগলটি বাঘে খেয়েছে। তখন রাখাল বলল, আল্লাহ কোথায় থাকবেন? এ কথা শুনে উমর (রা.) কেঁদে ফেললেন এবং রাখালের মালিকের কাছে গেলেন এবং তার কাছ থেকে তাকে কিনে নিয়ে মুক্ত করলেন।’ (মিনহাজুল মুসলিম)
বস্তুত ভারবাহী প্রাণী অসহায় হয়ে দৃঢ়ভাবে হাঁটু গেড়ে লুটিয়ে পড়লে, মালিকের আপ্রাণ চেষ্টা থাকে অবোধ প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি দেখানোর। বান্দাও যখন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির ব্যাকুলতায় মুরাকাবারত হয়, তখন সে সিফাতে রাব্বানির পর্যায়ে পৌঁছে। তখন মহাপ্রভু হয়ে যান বান্দার, বান্দা হয়ে যান আল্লাহর বন্ধু। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধের ঘোষণা...তখন আমি তার ওই কান হয়ে যাই, যার দ্বারা সে শোনে, তার ওই চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে, তার ওই হাত হয়ে যাই, যার দ্বারা সে ধরে এবং তার ওই পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে...।’” (হাদিসে কুদসি, বুখারি)
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.