বাংলাদেশে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত প্রায় ১ কোটি মানুষ। এর মধ্যে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। তাদের রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনেই ব্যয় হয় অন্তত ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাপী লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ও সি।
বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে এই রোগে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ ২৮ জুলাই ২০২৫ পালিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লমবার্গ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আবিষ্কার করেন। তিনি এই রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষাব্যবস্থা উন্নত করেন ও টিকা দেওয়া শুরু করেন।
চিকিৎসাবিদ্যায় তার এই অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে তার জন্মদিনে (২৮ জুলাই) বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়।
হেপাটাইটিস শব্দটি গ্রিক ‘হেপার’ থেকে এসেছে, যার অর্থ যকৃৎ এবং ‘টাইটিস’ অর্থ প্রদাহ। হেপাটাইটিস মূলত জ্বর, ক্ষুধা কমে যাওয়া, বমি ভাব, বমি হওয়া এবং পেটে ব্যথার মতো লক্ষণ দিয়ে শুরু হয়। এটি জন্ডিস, গাঢ় প্রস্রাব, ফ্যাকাশে মল এবং কিছু ক্ষেত্রে তীব্র যকৃৎ অকার্যকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের রোগী বাড়ছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। দেশে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। তারা বলছেন, লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া লিভারের রোগের চিকিৎসায় প্রতি বছর ব্যয় হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, এদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ১০ লাখ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনেই ব্যয় হয় কমপক্ষে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একইভাবে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ৫০ শতাংশ বাংলাদেশের নাগরিকের চিকিৎসার ব্যয় গিয়ে দাঁড়াবে ৩ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোয় যে পরিমাণ রোগী ভর্তি হন, তাদের ১০ থেকে ১২ শতাংশ লিভারের রোগে আক্রান্ত। এর বেশিরভাগই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত।
প্রখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট (২০১৯)-এর তথ্য অনুসারে, যকৃৎ ক্যান্সারের শতকরা ৪২ ভাগ রোগী এইচবিভি (হেপাটাইটিস বি) এবং শতকরা ৩১ ভাগ রোগী এইচসিভি (হেপাটাইটিস সি) দ্বারা দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমিত ছিল। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নামক এক জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত। বর্তমানে শতকরা প্রায় ছয়জন মানুষ এই ভাইরাস দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে বহন করছেন। দীর্ঘমেয়াদি যকৃতের রোগ ও যকৃতের ক্যান্সারের প্রধানতম কারণ এই ডিএনএ ভাইরাস।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাত কৌশলের ২০২০ সালে কিছুটা লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, যা শিশুদের টিকা ও রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রমের মাধ্যমে। এখন চার বছরের কম বয়সী শিশুদের বি ভাইরাসে আক্রান্তের হার শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। প্রতি বছর বি ভাইরাস দ্বারা নতুনভাবে সংক্রমিত হচ্ছে লাখে ২০ জন এবং বি ভাইরাসের কারণে বছরে মৃত্যু হয় লাখে ১০ জনের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৫ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বি ভাইরাস নির্মূলে কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। চার বছরের কম বয়সী শিশুদের বি ভাইরাস সংক্রমণ কমিয়ে ২০২৫-এ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০৩০-এ শূন্য দশমিক ১ শতাংশে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। নতুনভাবে সংক্রমণের সংখ্যাও প্রতি লাখে ২০২৫-এ ১১ জন এবং ২০৩০-এ দুজনে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বি ভাইরাসজনিত মৃত্যুহার ২০২৫-এ প্রতি লাখে সাত এবং ২০৩০-এ প্রতি লাখে চারে নামিয়ে আনতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাত কৌশল-২০২২।
বি ভাইরাস সংক্রমণ রোধে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাত কৌশল ২০২২-এর মূল লক্ষ্য হলো জন্মের পরপর সব শিশুকে প্রথম ডোজ টিকা এবং অন্যসব শিশুকে শিডিউলের সব টিকা প্রদানের হার ২০৩০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৯০ শতাংশের ওপরে রাখা। বর্তমানে বি ভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমান বলেন, 'হেপাটাইটিস একটি প্রাণঘাতী রোগ। বিশেষ করে বি ও সি ভাইরাসের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই রোগ পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবশ্যই পানযোগ্য পানি ও খাবার বিশুদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া সকল রোগীকে শনাক্তের আওতায় আনতে হবে এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।'
প্রকাশক: মোঃ শরিফুল ইসলাম। যোগাযোগ: মেডিকেল পূর্ব গেট, বুড়িরহাট রোড, রংপুর, বাংলাদেশ।
Copyright © 2025 RCTV ONLINE. All rights reserved.